বারবার খুলে পড়ছে মেট্রোর বিয়ারিং প্যাড?
নিজস্ব প্রতিবেদক : এক বছরের ব্যবধানে দুইবার খুলে পড়েছে ঢাকা মেট্রোরেল লাইনের বিয়ারিং প্যাড। প্রথমবার এতে কোনো প্রাণহানি না ঘটলেও এবার আর এড়ানো যায়নি। ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন এক ব্যক্তি। এতে ব্যস্ত নগরীতে মেট্রোরেল চলাচলে নাগরিকদের নিরাপত্তা নিয়ে একদিকে যেমন শঙ্কা তৈরি হয়েছে, অন্যদিক প্রশ্ন উঠছে ব্যবহৃত বিয়ারিংয়ের মান ও মেট্রোরেলের নির্মাণ ত্রুটি নিয়ে।
রোববার (২৬ অক্টোবর) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মেট্রোরেলের ফার্মগেট স্টেশনের পশ্চিম পাশে ৪৩৩ নং পিলারের ওপর থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার ঘটনা ঘটে। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান আবুল কালাম আজাদ (৩৫) নামের এক পথচারী।
এ বিষয়ে তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোবারক হোসেন বলেন, ফার্মগেট মেট্রো স্টেশনের নিচে খামারবাড়ি কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটের সামনের ফুটপাত দিয়ে ওই পথচারী হেঁটে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ ওপর থেকে বিয়ারিং প্যাড পড়ে তার মাথায়। আঘাতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
এর আগে গত বছর ১৮ সেপ্টেম্বর খামারবাড়ি এলাকাতেই মেট্রোরেলের একটি পিলার থেকে একইভাবে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে। সেই ঘটনায় কেউ হতাহত না হলেও মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ থাকে প্রায় ১১ ঘণ্টা।
বারবার মেট্রোরেল লাইনের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ায় জনমনে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে ‘মানহীন’ বিয়ারিং প্যাড সরবরাহ ও নির্মাণ ত্রুটি নিয়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনারও সৃষ্টি হয়েছে। কেউ কেউ এর জন্য বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের নির্মাণে ত্রুটি রেখে দেওয়া এবং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের রক্ষণাবেক্ষণে ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন।
সৈয়দ নাজমুস সাকিব নামের একজন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাডের খুলে যাওয়ার ঘটনা নতুন না, আজকে প্রথমও না। মাত্র বছরখানেক আগে, ২০২৪ এর ১৮ই সেপ্টেম্বর খামারবাড়ির মেট্রোরেল ব্রিজ থেকে একটা বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছিল। ১১ ঘণ্টা মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ ছিলো সেদিন।’
তিনি আরও লেখেন, ‘আওয়ামী লীগ আমলে মেট্রোরেল নির্মাণের সময়ই এই বিয়ারিং প্যাডের মান নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিলো বুয়েট। কারণ বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট এর করা সাস্টেইনেবিলিটি টেস্টে ফেইল করেছিল এই প্যাডগুলো। এমনকি বুয়েট থেকে এই রাবার বিয়ারিং প্যাডের পরিবর্তে পট বিয়ারিং প্যাড ব্যবহার করার পরামর্শও দেওয়া হয়। কারণ পট বিয়ারিং প্যাডের লোড ক্যাপাসিটি বেশি। কিন্তু অফিশিয়ালি লিখিত আপত্তি জানানোর পরেও ইটাল-থাই কোম্পানির সরবরাহকৃত এই ত্রুটিপূর্ণ রাবার বিয়ারিং প্যাডই স্থাপন করা হয় মেট্রোরেলে। তো আজকে এই বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে একজনের প্রাণ চলে গেলো। একটা মানুষ জাস্ট নরমালি হাঁটছিলো আর হঠাৎ সে নাই। নাই মানে আর নাই! ন্যূনতম জবাবদিহিতা নাই আর বিচার তো আশাই করি না। এই মানুষের জায়গায় কাল আপনি বা আমিও থাকতে পারি।’
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে দায়ী করে তিনি আরও লেখেন, ‘এক বছরেও বিয়ারিং প্যাডের ইস্যু এর আগে সামনে আসার পরেও কেন এই ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হলো না, ইন্টেরিম সরকার?’
মেট্রোলের বিয়ারিং প্যাড নিয়ে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে দৈনিক বণিক বার্তায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদন অনুসারে, মেট্রোরেলের লাইনে ‘মানহীন’ বিয়ারিং প্যাড সরবরাহের অভিযোগ ওঠে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইতাল-থাইয়ের বিরুদ্ধে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, বুয়েটের ল্যাবে পরীক্ষা চালিয়ে উত্তরা-আগারগাঁও অংশের দুটি প্যাকেজের জন্য আমদানি করা বিয়ারিং প্যাডের মান খারাপ পাওয়া গেছে। এসব বিয়ারিং প্যাড সরবরাহ করেছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইতাল-থাই।
ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মেট্রোরেলে ব্যবহারের আগে বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগে এসব বিয়ারিং প্যাডের কারিগরি মান পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় দেখা গেছে, একাধিক বিয়ারিং প্যাডের মান যথাযথ নয়। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের এক সভায়ও বিষয়টি উঠে আসে। পরে অবশ্য মানোত্তীর্ণ না হওয়ায় নতুন বিয়ারিং প্যাড আমদানির উদ্যোগ নেওয়ার খবর পাওয়া যায়।
নির্মাণজনিত ত্রুটিকেই দুষছেন বিশেষজ্ঞ
বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বুয়েটের দুর্ঘটনা রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক ও পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শামসুল হক বাংলানিউজকে বলেন, মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার সঙ্গে মানহীন বা মানসম্মত হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। এটি নির্মাণজনিত ত্রুটির কারণে হয়েছে। বিয়ারিং প্যাড মানহীন হলে বেশিদিন টিকবে না। কিন্তু সেটি খুলে পড়বে না। মেট্রোরেল নির্মাণের সময় কনস্ট্রাকশনে গাফিলতি ছিল বলে বারবার বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ছে। এছাড়া রক্ষণাবেক্ষণেও গাফিলতি ছিল বলেই এটা হয়েছে।
মেট্রোরেল নির্মাণে দায়হীনভাবে কাজ হয়েছে অভিযোগ করে তিনি আরও বলেন, এখানে গুণগত কোনো কাজ হয়নি। সেই মানহীন কাজটি আমাদের গছিয়ে দেওয়া হয়েছে। মেট্রোরেল নির্মাণে পয়সার কোনো কমতি ছিল না, মেধারও কোনো কমতি ছিল না, এই জায়গায় গাফিলতি ছিল। কাউকে না কাউকে এর দায় নিতে হবে। যেহেতু একজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তাই এটিকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যদি এড়িয়ে যাই, তাহলে পৃথিবীতে এলিভেটেড, মেট্রোরেলের নিরাপত্তায় জনগণের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হবে।
তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে ব্যবস্থা, ডিএমটিসিএল
বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার কারণ মানহীনতা নাকি নির্মাণ ত্রুটি- জানতে চাইলে ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের (লাইন-৬) প্রকল্প পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আব্দুল ওহাব বলেন, এটা এখনই বলা মুশকিল। কী কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেটি আমরা দেখছি। এজন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমরা এখন মেট্রো চলাচলের জন্য ওই বিয়ারিং মেরামতের কাজ করছি। আশা করি, রাতের মধ্যে মেরামত হয়ে যাবে।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে কোনো ত্রুটি পাওয়া গেলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। তদন্ত কমিটি যে প্রতিবেদন দেবে সেটার আলোকে আমরা দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।
প্রাথমিকভাবে পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ, পরিবারের কর্মক্ষম ব্যক্তিকে চাকরি
মেট্রোরেলের বিয়ারিং পড়ে পথচারী আজাদের মৃত্যুর পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন সড়ক পরিবহন ও সেতু এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান। তিনি সেখানে সাংবাদিকদের জানান, এই ঘটনায় সেতু বিভাগের সচিব মোহাম্মদ আব্দুর রউফকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে তারা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবেন৷ প্রতিবেদনে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে করণীয় সুপারিশও থাকবে।
তিনি আরও জানান, এ ঘটনায় নিহত ব্যক্তির পরিবারকে প্রাথমিকভাবে পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। এছাড়া তার পরিবারে কর্মক্ষম কোন ব্যক্তি যদি থাকে তাকে মেট্রোরেলে চাকরির ব্যবস্থা করা হবে।
ফেসবুকে দেওয়া শেষ স্ট্যাটাসে বিষাদ
রোববারের দুর্ঘটনায় নিহত আজাদ শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ঈশ্বরকাঠি গ্রামের জলিল চোকদারের ছেলে। তিনি সপরিবারে থাকতেন নারায়ণগঞ্জের জলকাঠি এলাকায়।
আজাদ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে ঢাকায় একটি ট্রাভেল এজেন্সি পরিচালনা করতেন। স্বজনরা জানান, তিনি ব্যবসায়িক কাজে নিয়মিত ফার্মগেট এলাকায় যাতায়াত করতেন। তার দুই ছেলে-মেয়ের মধ্যে ছেলে আব্দুল্লাহর বয়স পাঁচ বছর আর মেয়ে সুরাইয়া আক্তারের বয়স তিন বছর।
শনিবার (২৫ অক্টোবর) রাতে আজাদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্টে লেখেন, ‘ইচ্ছে তো অনেক আপাতত যদি জীবন থেকে পালিয়ে যেতে পারতাম।’ মৃত্যুর পর তার এ ফেসবুক পোস্ট এখন ভাইরাল।
দুর্ঘটনাস্থল থেকে তার লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। খবর পেয়ে তার স্বজনরা হাসপাতালে ছুটে আসেন। মর্গের সামনে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন আজাদের স্ত্রী আইরিন আক্তার পিয়া। ছেলেকে কোলে নিয়ে তিনি বারবার বলছিলেন, ‘আজকে (কালামকে) আমি বিদায় দিতে চাইনি। দরজা লাগাতেও যাইনি। আমার বাচ্চাদের কী হবে?’
মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড কী?
মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড হলো রাবার ও ইস্পাতের মিশ্রণে তৈরি আয়তাকার একটি অংশ, অনেকটা মোটা মেট্রেসের মতো। এই প্যাড বসানো হয় মেট্রোরেলের উড়ালপথ (ভায়াডাক্ট) ও স্তম্ভের (পিলার) মাঝখানে।
মেট্রোরেলের উড়ালপথ বা ভায়াডাক্ট কংক্রিটের তৈরি, যা ৩০ থেকে ৪০ মিটার দৈর্ঘ্যের একাধিক স্প্যান জোড়া দিয়ে গঠিত। এই ভায়াডাক্ট বসানো হয় নিচের পিলারের ওপর। যেহেতু দুটোই কংক্রিটের তৈরি, তাই সরাসরি সংযোগ হলে ঘর্ষণ, ক্ষয় বা স্থানচ্যুতি ঘটতে পারে। এই সমস্যার সমাধানেই মাঝখানে ব্যবহার করা হয় বিয়ারিং প্যাড। এটি ঘর্ষণ কমায়, কম্পন শোষণ করে এবং পুরো কাঠামোর স্থায়িত্ব বজায় রাখে। প্রতিটি পিলারের নিচে থাকে চারটি করে বিয়ারিং প্যাড।