পাকিস্তানে সেনাপ্রধানের ক্ষমতা বৃদ্ধির নতুন আইন পাস
আন্তর্জাতিক ডেস্ক : পাকিস্তানের সংসদ সেনাপ্রধানের ক্ষমতা সম্প্রসারণ এবং সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা সীমিত করার জন্য একটি সাংবিধানিক সংশোধনী অনুমোদন করেছে। বুধবার (১২ নভেম্বর) পাকিস্তানের পার্লামেন্ট দেশটির সংবিধানের ২৭তম সংশোধনী পাস করেছে। সমালোচকরা বলেছেন, এই পদক্ষেপ দেশের গণতন্ত্রের মৃত্যু হয়েছে।
পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ দুই-তৃতীয়াংশেরও ( ২৩৪ ভোট) বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতার সঙ্গে আইনটি অনুমোদন করেছে, যেখানে মাত্র চারজন আইনপ্রণেতা বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন।
এর আগে সোমবার, বিরোধীদের বয়কটের পরও উচ্চকক্ষ সিনেটে পাস হয় বিলটি। সাংবিধানিক পরিবর্তনের জন্য দ্রুত এটি পাস হয়েছে, যা অস্বাভাবিক। এই ধরনের সংশোধনীগুলোর জন্য সাধারণত সপ্তাহ বা মাস বিবেচনার প্রয়োজন হয়। রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পরে সংশোধনীটি আইনে পরিণত হবে, যা একটি আনুষ্ঠানিকতা।
পাকিস্তানের ক্ষমতাধর সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির এই ২৭তম সংশোধনীর প্রধান উপকারভোগী। সেনাপ্রধান আসিম মুনির এখন প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধানের নতুন পদে উন্নীত হবেন, যার ফলে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীও তার অধীনে থাকবে। তার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর, তিনি তার পদমর্যাদা বজায় রাখবেন এবং আজীবনের জন্য আইনি অনাক্রম্যতা পাবেন।
সামরিক শক্তি, বিচার বিভাগ
প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ সংশোধনীটিকে প্রতিষ্ঠানগুলোর সামঞ্জস্য এবং জাতীয় ঐক্যের দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে স্বাগত জানান।
শরিফ বলেন, ‘যদি আমরা আজ এটি সংবিধানের অংশ করেছি, তা কেবল ফিল্ড মার্শালকে কেন্দ্র করে নয়। এটি বিমানবাহিনী এবং নৌবাহিনীকেও স্বীকৃতি দিয়েছে।’ তিনি স্পিকারকে প্রশ্ন করে বলেন, ‘এতে কি ভুল হয়েছে? দেশগুলো তাদের বীরদের সম্মান করে… আমরা জানি কিভাবে আমাদের বীরদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং তা অর্জন করতে হয়।’
সমালোচকরা বলছেন, এই পরিবর্তন সামরিক বাহিনী এবং ক্ষমতাসীন জোটের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করছে। সংশোধনীর অধীনে, সাংবিধানিক মামলাগুলো সুপ্রিম কোর্ট থেকে একটি নতুন ফেডারেল সাংবিধানিক আদালতে স্থানান্তরিত হবে।
যার বিচারকরা সরকার কর্তৃক নিযুক্ত হবেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সুপ্রিম কোর্ট সরকারি নীতিমালা অবরুদ্ধ করেছে এবং প্রধানমন্ত্রীদের ক্ষমতাচ্যুত করেছে।
কারাবন্দি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)-এর আইন প্রণেতারা ভোটের আগে ওয়াক আউট করে এবং প্রতিবাদ জানাতে বিলের কপি ছিঁড়ে ফেলেন। তারা অভিযোগ করেন, তাদের সঙ্গে পরামর্শ করা হয়নি।
পিটিআই মুখপাত্র জুলফিকার বুখারি বলেছেন, “কোনো সংসদ সদস্য গণতন্ত্র এবং বিচার বিভাগকে নির্মূল করার বিষয়ে চিন্তা করেননি। দেশটি একটি ‘কলা প্রজাতন্ত্রে’ পরিণত হওয়ার সময় তারা নীরব পর্যবেক্ষক থাকার পক্ষে ভোট দিয়েছেন। পাকিস্তানের সংবিধান শান্তিতে বিশ্রাম নিন।”
বিচার ব্যবস্থার জন্য ‘মৃত্যু-ঘণ্টা’
আইন বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, এই সংস্কার বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে। সংবিধানজ্ঞানী আইনজীবী আসাদ রহিম খান বলেন, ‘আমরা সম্পূর্ণ অজানা অঞ্চলের মুখোমুখি। এটি আমাদের বিচার ব্যবস্থায় এমন একটি ভাঙন, যা আমরা প্রায় একশ বছর ধরে দেখিনি। যারা এখন একে অপরকে বাহবা দিচ্ছেন, তাদের সেই সময়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। যখন তারা সেই একই আদালত থেকে সহায়তা চাইবে, যেগুলোকে তারা ধ্বংস করেছে এবং রাষ্ট্রের অধীনে আনিয়েছে।’
সংবিধানজ্ঞানী মির্জা মইজ বৈগ বলেন, এই সংশোধনী স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়েছে। এটি প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতিকে নতুন ফেডারেল সংবিধানিক আদালতের প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারক নিজস্ব পছন্দমতো নির্বাচনের ক্ষমতা দিচ্ছে। ফলে সরকারি ক্ষমতার অতিরিক্ত প্রয়োগ পরীক্ষা করার ক্ষমতা দুর্বল হচ্ছে।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনী দীর্ঘদিন ধরে ব্যাপক প্রভাবশালী, তবে এই সংস্কার তাদের আরো শক্তিশালী সাংবিধানিক ভিত্তি প্রদান করছে। এটি পরবর্তীতে পরিবর্তন করা কঠিন হবে।
সূত্র : রয়টার্স।