সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪   পৌষ ৯ ১৪৩১   ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

২৩

‘বিচার বিভাগের প্রতি কোনও সরকারই যথার্থ নজর দেয়নি’

প্রকাশিত: ২১ নভেম্বর ২০২৪  

নিজস্ব প্রতিবেদক : যদি মানুষ অনুভব করে যে বিচার বিভাগ স্বাধীন নয়, তাহলে রাষ্ট্রে সেই বিচার বিভাগে কোনও আস্থার স্থান থাকে না। বিচার বিভাগের প্রতি কোনও সরকারই কখনও যথার্থ নজর দেয়নি। ফলে বিচার বিভাগ সরকারের সবচাইতে দুর্বলতম বিভাগে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী।

বুধবার (২০ নভেম্বর) জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘নির্বাহী বিভাগ হতে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের ১৭ বছর’ শীর্ষক এক মুক্ত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। মিনৌরী বাংলাদেশের সহায়তায় স্বেচ্ছাসেবী মানবাধিকার সংগঠন ‘হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশন’ এবং মাসিক আইন ও বিচার জাতীয় প্রেসক্লাবের ‘তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হল’-এ এই মুক্ত আলোচনা সভার আয়োজন করে।

মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বিচার বিভাগের আজকের অবস্থা আমাদের সামষ্ঠিক ব্যর্থতা। আইনজীবীরা বিচারকদের বিচারিক কার্যক্রমের সহযোগী। কোর্টে বেঞ্চ আর বার একই মুদ্রার দুই পিঠ। এজন্য এই দুই অংশকে সমন্বয়ের মাধ্যমে বিচার বিভাগ সাজাতে হবে। বিচারকদের মানসিকভাবে স্বাধীন হতে হবে। তা-না হলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কাঙ্ক্ষিত ফল আনতে পারবে না।

সাবেক এই বিচারপতি বলেন, জুডিশিয়ারির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো তার এক্সেস। আইন বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের স্বচ্ছতা নির্ধারণে বিচার বিভাগ কাজ করতে পারে, কিন্তু স্বাধীনভাবে। বিচার বিভাগের টাইরানির চেয়ে বাজে বিষয় হতে পারে না। এর কারণে মানুষ যে ভোগান্তিতে পড়ে তা অস্বাভাবিক। যদি মানুষ অনুভব করে যে বিচার বিভাগ স্বাধীন নয়, তাহলে রাষ্ট্রে সেই বিচার বিভাগের কোনও আস্থার স্থান থাকে না।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ শফিকুর রহমান। এসময় আলোচনায় অংশ নেন আইন সংস্কার কমিশনের সদস্য মাজদার হোসেন; সুপ্রিম কোর্টের সাবেক রেজিস্টার, জেলা জজ ও সংবিধান আলোচক ইকতেদার আহমেদ; গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্য জিমি আমির; বাংলাদেশ আইনজীবী অধিকার পরিষদের যুগ্ম-আহবায়ক অ্যাডভোকেট মো. খাদেমুল ইসলাম; জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট শাকিল আহমেদ; সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সাদিয়া আরমান প্রমুখ। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. পারভেজ।

আইন সংস্কার কমিশনের সদস্য মাজদার হোসেন বলেন, পৃথক সচিবালয় স্থাপনের দাবি নিয়েই আমাদের সংগ্রাম। নেই দাবি থেকে আদৌ সরে যাইনি এবং এ দাবির প্রতি অটল রয়েছি। বিচার বিভাগ প্রধান বিচারপতির নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে। এমন একটি অবকাঠামো তৈরি করতে হবে যেখানে বিচারকদের নিয়োগ, নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিষয়ক সকল সিদ্ধান্ত প্রধান বিচারপতির নিকট অর্পিত থাকবে।

মাজদার হোসেন বলেন, যেই সিআরপিসি ব্রিটিশরা ফেলে দিয়েছে, আমরা এখনো তা আঁকড়ে ধরে আছি। বাংলাদেশে কাগজে কলমে বিচার বিভাগ স্বাধীন হলেও তা আমার আশা পূরণ করতে পারেনি। রায়ের ১২ দফার কোনটাই পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। আজও বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করে প্রশাসন। অথচ আইন বিভাগের কাজে প্রশাসন ইন্টারফেয়ার করতে পারে না। বিগত ৫৩ বছরে কোন রাজনৈতিক দলও জনস্বার্থে আইন করেনি, তারা নিজেদের রক্ষা ও ক্ষমতার স্বার্থে আইন করেছে। তারা কোন কালাকানুন বাতিল করেনি। আমরা আষ্টেপৃষ্ঠে শাসকগোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

সুপ্রিম কোর্টের সাবেক রেজিস্টার, জেলা জজ ও সংবিধান আলোচক ইকতেদার আহমেদ বলেন, বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ এখন আইন মন্ত্রণালয়ের কাছে। তা সুপ্রিম কোর্টের অধীনে নিতে হবে। তবে আগে সুপ্রিম কোর্টে তা নিয়ন্ত্রণের মত অবকাঠামো ও পরিস্থিতি ঠিক করতে হবে। অধিকতর যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা নিম্ন যোগ্যতাসম্পন্ন লোকদের নিয়ন্ত্রণ করবে। কিন্তু বর্তমানে উচ্চ আদালতে যারা বিচারক হিসাবে আসীন রয়েছেন তাদের যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ।

গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্য জিমি আমির বলেন, মানুষ সুবিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছিল বলেই ছাত্র-জনতার আন্দোলন হয়েছে। তাই সুবিচার নিশ্চিত করতে হবে। আর এজন্যই বিচার বিভাগকে পুর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা দিতে হবে।

বাংলাদেশ আইনজীবী অধিকার পরিষদের যুগ্ম-আহবায়ক অ্যাডভোকেট মো. খাদেমুল ইসলাম খাদেমুল বলেন, বিচার বিভাগ ও বিচারকদের স্বাধীনতা নিশ্চিত না করতে পারলে মানুষের আস্থা অর্জন সম্ভব নয়।

উল্লেখ্য, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ নিছক জজ বা উকিলদের বিষয় না। পৃথকীকরণ না হলেও জজ সাহেব বেতন বা উকিল সাহেব ফি পাবেন, তাদের লস নেই। ক্ষতি পুরোটাই জনগণের। এটা জনগণের প্রতিদিনের ন্যায় পাওয়ার বিষয়, একটি সাংবিধানিক প্রত্যাদেশ। শুধু তাই নয়, এদেশের জনগণের কমপক্ষে ১০০ বছরের অধিক সময়ের প্রত্যাশা ও রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকারের অন্যতম একটি বিষয় হলো- বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ। অবিভক্ত বঙ্গের বিধানসভায় ১৯২১ সালে পাস হয় নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব। তারপর, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার ১৫নং দফা ছিল বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ।

১৯৭০ সালে যে নির্বাচনের ফলের ভিত্তিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে, তাতে বিজয়ী পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নির্বাচনী মেনিফেস্টোর অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল- বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ থেকে সম্পূর্ণভাবে পৃথক করা। তারপর আমাদের ১৯৭২ সালের সংবিধানের অন্যতম ম্যান্ডেট ঘোষণা করা হয় পৃথকীকরণকে। ১৯৯০ সালের তিন জোটের রূপরেখার ৩(খ) দফায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষ ও আইনের শাসন নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করা হয়। ২০২৪ সালের শিক্ষার্থী-জনতার জুলাই অভ্যুত্থানের প্রধান স্পিরিট ছিল রাষ্ট্র মেরামত ও নয়া বন্দোবস্ত কায়েম করা।

এই বিভাগের আরো খবর

© সকল স্বত্ব www.jugoshankho.com কর্তৃক ® সংরক্ষিত