সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪   পৌষ ৯ ১৪৩১   ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

১৬৯৮

মদের বোতলে রাখা পানি পানের বিধান কী?

মাওলানা কাসেম শরীফ 

প্রকাশিত: ১৬ এপ্রিল ২০১৯  

মাদকের ভয়ংকর থাবায় বিশ্বব্যাপী বিপন্ন মানবসভ্যতা। এর সর্বনাশা ছোবলে অতীতে বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। বর্তমানে ভেঙে পড়ছে অসংখ্য পরিবার। বিঘ্নিত হচ্ছে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা। ব্যাহত হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন। বৃদ্ধি পাচ্ছে চোরাচালানসহ মানবতাবিধ্বংসী অসংখ্য অপরাধ।

যেসব বস্তু সেবনে উন্মত্ততা সৃষ্টি হয় ও বুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে ফেলে অথবা বোধশক্তির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে, পরিভাষায় সেগুলোকে মাদকদ্রব্য বলা হয়। ইসলাম সব ধরনের মাদকতা তথা নেশাদ্রব্য হারাম ঘোষণা করেছে। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, 'প্রত্যেক নেশাদ্রব্যই মদ, আর যাবতীয় মদই হারাম।' (মুসলিম ও মেশকাত, হাদিস : ৩৬৩৮)

মাদকাসক্তির কারণে সব জনপদেই চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাস বেড়ে গিয়ে মানুষের জান-মাল ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। সমাজের বেশির ভাগ অপরাধের জন্য মুখ্যভাবে দায়ী এই মাদকতা। এ জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'মদ পান কোরো না। কেননা তা সব অপকর্মের চাবিকাঠি।' (ইবনে মাজাহ : হাদিস : ৩৩৭১)

ইসলামপূর্ব আরবে মাদকতা মহামারির আকার ধারণ করেছিল। এ অবস্থা থেকে তাদের ফিরিয়ে আনতে ধীরে ধীরে পর্যায়ক্রমে মাদকতা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সুরা বাকারার ২১৯ নম্বর আয়াতে মাদকতা ও জুয়া খেলাকে মহাপাপ বলা হয়েছে। এরপর সুরা নিসার ৪৩ নম্বর আয়াতে মদ্য পান করে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামাজ পড়তে নিষেধ করা হয়েছে। তারপর সুরা মায়েদার ৯০-৯১ নম্বর আয়াতে মদ চিরতরে হারাম করে দেওয়া হয়েছে। সুরা মায়েদার ৯০ নম্বর আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘তোমরা এসব (মদ, জুয়া ইত্যাদি) থেকে বিরত থাকো। ’ কোরআনের পাশাপাশি বহু হাদিসেও মদ পান নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এক হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মদ পানকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না। ’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩৩৭৬)

মদ ও মাদকদ্রব্য কিছুতেই ইসলামের সঙ্গে যায় না। মদের সঙ্গে সম্পৃক্ত দশ শ্রেণির মানুষকে হাদিসে অভিশাপ দেওয়া হয়েছে। তারা হলো, মদের নির্যাস বেরকারী, মদ্যপায়ী, পরিবেশক, বিক্রেতা, ক্রেতা, উৎপাদনকারী কর্মচারী, উৎপাদক, পরিবাহক, আমদানিকারক ও লভ্যাংশ ভোগকারী। (তিরমিজি ও মেশকাত, হাদিস : ২৭৭)

প্রশ্ন হলো, মদ যখন এতই ঘৃণিত বস্তু, তাহলে যেসব বোতলে মদ রাখা হয়, সেসব বোতলে পানি রেখে তা পান করা কি বৈধ? দেখা যায়, বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে বা অতিথিশালায় মদের বোতলে রাখা পানি পান করতে দেওয়া হয়, এমতাবস্থায় করণীয় কী?

এ প্রশ্নের জবাব হলো, যদি ভালোভাবে মদের বোতল পরিস্কার করা হয়, এর মধ্যে মদের কোনো চিহ্ন না থাকে, তাহলে এমন পাত্র বা বোতলে রাখা পানি পান করা বৈধ। যদিও ইসলামের প্রথম যুগে মদের পাত্রে রাখা পানি পান করতে নিষেধ করা হয়েছিল। ইসলামের প্রথম যুগে মূলত ৩টি কারণে মদের পাত্রে রাখা পানি পান করতে নিষেধ করা হয়েছিল।

এক. সেসব পাত্রে মদের চিহ্ন অবশিষ্ট ছিল।

দুই. সে সময় সবেমাত্র মদ হারাম করা হয়েছিল। তাই মদের পাত্রে পানি পান করলে মদের কথা স্বরণ হয়ে যেতে পারত। তাই সতর্কতামূলক এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল।

তিন. মদের প্রতি যেন পরিপূর্ণ ঘৃণা সৃষ্টি হয়, সেজন্য তখন মদের পাত্র ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। পরে যখন মদ হারাম হওয়ার বিষয়টি সবার জানা হয়ে যায়, এবং সাহাবিদের মধ্যে মদের প্রতি প্রচন্ড ঘৃণা জন্মে যায়, তখন ওই সব পাত্র ভালোভাবে পরিস্কার করে তাতে রাখা পানি পান ইত্যাদি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। (তাকমিলা ফাতহুল মুলহিম : ৩/৩৫১)

এ প্রসঙ্গে একটি হাদিস পাওয়া যায়। হজরত বুরাইদা (রা.) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‌'আমি তোমাদের কিছু পাত্রের ব্যাপারে (মদ রাখার পাত্র) নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলাম। আসলে পাত্র কোনো কিছুকে হালাল বা হারাম করতে পারে না। তবে প্রতিটি মাদকদ্রব্য হারাম।' (সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর : ৫৩২৬, তিরমিজি, হাদিস নম্বর : ১৮৬৯)

উল্লিখিত হাদিস থেকে জানা যায়, মদের বোতল বা পাত্র ভালোভাবে পরিস্কার করে তাতে পানি রাখলে সে পানি পান করা বৈধ।

লেখক : তাফসিরকারক ও সাংবাদিক

© সকল স্বত্ব www.jugoshankho.com কর্তৃক ® সংরক্ষিত