ঢাকা, বাংলাদেশ

৩০ লাখের কাজ, লেগেছে দুই কোটি ১৬ লাখ টাকা

প্রকাশিত :

নিজস্ব প্রতিবেদক : গুলশানে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) চেয়ারম্যানের সরকারি বাসভবন সংস্কারকাজে গুরুতর অনিয়ম পেয়েছে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি। তবে এর আগে রাজউক তদন্তে নামলেও কোনো অনিয়ম খুঁজে পায়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংস্থাটির তদন্ত ছিল ‘লোক-দেখানো’।

গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি বলছে, বাসভবনের ৮০ শতাংশ সংস্কারকাজ শেষ হওয়ার পর দরপত্র আহ্বান করা হয়। প্রথমে প্রাক্কলন খরচ ধরা হয়েছিল ৩০ লাখ টাকা। পরে সেই কাজ শেষ করতে খরচ করা হয় দুই কোটি ১৬ লাখ টাকা, যা প্রথম প্রাক্কলনের প্রায় সাত গুণ।

এই অনিয়মের সঙ্গে রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. ছিদ্দিকুর রহমান, প্রধান নগর স্থপতি মোস্তাক আহমেদ, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রাহাত মুসলেমীনের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে তদন্ত কমিটি। গণপূর্তের তদন্ত কমিটি দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও সুপারিশ করেছে। এরই মধ্যে সাবেক চেয়ারম্যান মো. ছিদ্দিকুর রহমান গত ২৪ অক্টোবর মারা যান।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যানের সরকারি বাসভবনটি (চেয়ারম্যান বাংলো) গুলশানের ৬ নম্বর সড়কের ১ নম্বর প্লটে। তদন্তে উঠে এসেছে, লুকোচুরি করে বাংলোটির সংস্কারকাজ শুরু হয় গত বছর মার্চে। পরে গত জানুয়ারিতে নামকাওয়াস্তে দরপত্র আহ্বান করে মেসার্স নিয়াজ ট্রেডার্স নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাগজে-কলমে কাজ দেওয়া হয়।


বাংলো সংস্কারকাজে অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর রাজউক গত মে মাসে তদন্তে নামে। সপ্তাহখানেক পর রাজউকের তদন্ত দল জানিয়ে দেয়, সংস্কারকাজে কোনো অনিয়ম হয়নি। পরে ২৯ জুন গণপূর্ত মন্ত্রণালয় দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি করে। গত ২৭ আগস্ট তারা মন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।

এদিকে, রাজউকের মতো গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ও দায়ীদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিয়ে কাজের গুণগতমান নিরীক্ষার মাধ্যমে ঠিকাদারকে চূড়ান্ত পাওনা নিষ্পত্তির ব্যাপারে রাজউককে গত ৮ অক্টোবর চিঠি দেয় মন্ত্রণালয়। পরে এই ঘটনায় জড়িত দুই কর্মকর্তা প্রধান নগর স্থপতি মোস্তাক আহমেদ ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রাহাত মুসলেমীনকে গত ১৩ অক্টোবর কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে দায় সারে রাজউক।

রাজউক সূত্রে জানা যায়, গত বছর ৫ এপ্রিল রাজউকের চেয়ারম্যান পদে ছিদ্দিকুর রহমান যোগ দেওয়ার আগে ‘চেয়ারম্যান বাংলো’ সংস্কারের জন্য ৩০ লাখ টাকার একটি প্রাক্কলন প্রস্তুত করে সংস্থাটির প্রকৌশল বিভাগ। তবে আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের প্রকৌশলী দল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করে সেটি ভেঙে নতুন নির্মাণের সুপারিশ করে। সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছর ১৭ জুলাই নির্বাহী প্রকৌশলী (বাস্তবায়ন-৪) চেয়ারম্যান বাংলো চত্বরে নতুন ভবনের নকশা প্রস্তুতের জন্য রাজউক চেয়ারম্যানের কাছে একটি চিঠি দেন।

তবে কর্তৃপক্ষ এটি আমলে না নিয়ে গত বছর ৯ মে প্রধান নগর স্থপতি মোস্তাক আহমেদকে আহ্বায়ক করে চেয়ারম্যান বাংলোর প্রকল্প বাস্তবায়নে চার সদস্যের কমিটি করে। এই কমিটি বাংলো সংস্কারে একটি সভা করে দ্রুত নকশা অনুমোদন নিয়ে দরপত্র আহ্বান ও দ্রুত কাজ সম্পন্নের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে নকশা এবং দরপত্র ছাড়াই কমিটির আহ্বায়ক মোস্তাক আহমেদ ও সদস্য সচিব রাহাত মুসলেমীনের মৌখিক নির্দেশে ৯টি অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্সের (এনডিই) মাধ্যমে ভবনের সংস্কারকাজ শুরু করেন।

তবে এই অনিয়মে বাদ সাধেন রাজউক বাস্তবায়ন-৪-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ কাইছার। তিনি কমিটির আহ্বায়কের কাছে বাংলোর চলমান কাজের লিখিত নির্দেশনা, কাজের বিস্তারিত পরিকল্পনা ও নকশার অনুমোদিত কপি চেয়ে চিঠি দেন। এ কাজের নকশা অনুমোদন ও প্রাক্কলন প্রস্তুত করে দরপত্র না হওয়ায় রাজউকের সেই সময়ের চেয়ারম্যান ছিদ্দিকুর রহমানের চাপে গত বছর ৯ জুন এই নির্বাহী প্রকৌশলী চিঠিটি প্রত্যাহার করে নেন। তবে দরপত্র ছাড়া ওই বছরের মার্চে কাজ শুরু হলেও অক্টোবরে নকশা তৈরি করে দুই কোটি ৮৫ লাখ টাকার প্রাক্কলনে সইয়ের জন্য তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী উজ্জ্বল মল্লিককে চাপ দেন রাজউক চেয়ারম্যান। তবে উজ্জ্বল মল্লিক সই না করায় এবং বিষয়টি জানাজানি হলে ভবন সংস্কারের ৮০ শতাংশ কাজ শেষে তড়িঘড়ি করে গত ২৬ নভেম্বর সংস্কার খরচ আরও ৬৯ লাখ টাকা কমিয়ে দুই কোটি ১৬ লাখ টাকায় দ্বিতীয় প্রাক্কলন অনুমোদন করেন তৎকালীন চেয়ারম্যান। এই দরপত্রে শুধু মেসার্স নিয়াজ ট্রেডার্স অংশ নেয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মেসার্স নিয়াজ ট্রেডার্স ও ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স (এনডিই) যৌথভাবে ৯টি অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের রূপসা ভবনের বাস্তবায়নকারী ঠিকাদার।

রাজউকের তদন্ত অন্তঃসার

গত ৫ মে রাজউকের পাঁচ সদস্যের কমিটির আহ্বায়ক প্রধান প্রকৌশলী (প্রকল্প ও ডিজাইন) মোবারক হোসেনের নেতৃত্বে বাংলোর কাজের অনিয়মের তদন্ত শুরু হয়। এক সপ্তাহ পর ১৩ মে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের বক্তব্য ও নথি পর্যালোচনা করে জানা যায়, বাংলোর কাজ ই-জিপিতে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে হয়েছে। দরপত্রের আগে কাজ শুরুর ঘটনা ঘটেনি। তবে পাশের প্রকল্পের ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্সের (এনডিই) কিছু শ্রমিককে এই কাজে ব্যবহার করা হয়েছিল।

পরে এই অনিয়মের ঘটনায় গত ২৯ জুন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব জহিরুল ইসলাম খানকে আহ্বায়ক ও গণপূর্ত রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ কায়সার কবিরকে সদস্য সচিব করে দুই সদস্যের আরেকটি তদন্ত কমিটি করে মন্ত্রণালয়। এই তদন্ত কমিটি সংস্কারকাজের অনিয়মের সত্যতা পায়।

মন্ত্রণালয় ও রাজউকের কারসাজি

বাংলোর কাজে অনিয়ম নিয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দেয় ২৭ আগস্ট। প্রতিবেদনে দরপত্রের আগে কাজ শুরু ও প্রাক্কলন অনুমোদনে সরকারি নিয়ম ভঙ্গের অভিযোগ আনা হয়। এতে রাজউকের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কমিটি জড়িত তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা ও ভবিষ্যতে অনিয়ম রোধে পাঁচটি সুপারিশ দেয়। তবে মন্ত্রণালয় ২৫ সেপ্টেম্বরের নির্দেশনায় শুধু কাজের মান যাচাই ও কৃচ্ছ্র নীতি অনুসরণের দিকেই সীমাবদ্ধ থাকে।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ও তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক জহিরুল ইসলাম খান বলেন, তদন্তে আমরা যে তথ্য পেয়েছি, সেটাই প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছি। এর ভিত্তিতে আমরা প্রতিবেদনে সুপারিশ করেছি। সুপারিশ বাস্তবায়নের দায়িত্ব মন্ত্রণালয় ও রাজউকের।

রাজউকের সদস্য (প্রশাসন ও অর্থ) ড. মো. আলম মোস্তফা বলেন, গণপূর্তের তদন্ত কমিটির সুপারিশের আলোকে এই কাজের অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এখন পর্যন্ত কোনো চিঠিপত্র বা নির্দেশনা আমার কাছে আসেনি।

তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের বিষয়ে জানতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নজরুল ইসলামের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ধরেননি।