জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতি দুটোই রক্ষা করবে প্রমাণভিত্তিক নীতি
লাইফস্টাইল ডেস্ক : বাংলাদেশে তামাকজাত পণ্য ও নিরাপদ বিকল্পের অবৈধ বাণিজ্য নিয়ে এখন আলোচনা বেশ জমে উঠেছে। এই বিতর্কে স্পষ্টভাবে দুইটি মতামত সামনে এসেছে।
একদল মনে করে, বাস্তবসম্মত ও ভারসাম্যপূর্ণ নীতিই হতে পারে সবচেয়ে ভালো পথ—যেখানে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষিত থাকবে, বাজারের বাস্তবতাকেও গুরুত্ব দেওয়া হবে, আর ধূমপায়ীরা পাবে নিরাপদ ও নিয়ন্ত্রিত বিকল্পের সুযোগ।
অন্যদিকে, কিছু বিদেশি প্রভাবিত গোষ্ঠী সব ধরনের বিকল্প পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার দাবি তুলেছে, যা না দেশের বাস্তবতা বোঝে, না বিশ্বজুড়ে পাওয়া প্রমাণকে মানে। এই একপেশে ভাবনা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য নীতি ও অর্থনীতির অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
বছরের পর বছর ধরে সচেতনতামূলক কার্যক্রম, সতর্কতা এবং উচ্চ করের মতো পদক্ষেপ নেওয়ার পরও এখনও বাংলাদেশের প্রায় ৩৫%-এর বেশি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাকজাত পণ্য ব্যবহার করছেন। এর ফলে যে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হচ্ছে তা কমাতে নতুন এবং বাস্তবসম্মত নীতি প্রয়োজন।
বছরের শুরুতে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান খান বলেন, অবৈধ তামাক ও বিকল্প পণ্যের বাণিজ্যের কারণে দেশ বড় পরিমাণে রাজস্ব হারাচ্ছে।
তিনি বলেন, পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞার চেয়ে সঠিক নিয়ন্ত্রণ নীতি উত্তম, কারণ নিষেধাজ্ঞা প্রায়ই মানুষকে কালোবাজারে ঠেলে দেয়। অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও থাইল্যান্ডে এ ধরনের ঘটনা দেখা গেছে, যা রাজস্ব কমায় এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়।
বিশ্বে বিভিন্ন দেশ এখন কঠোর নিষেধাজ্ঞার বদলে নিয়ন্ত্রণভিত্তিক নীতি গ্রহণ করছে। সৌদি আরবে তামাক ক্ষতি হ্রাস (টোব্যাকো হার্ম রিডাকশন) এখন দেশের জাতীয় স্বাস্থ্য কৌশলের অংশ। ২০২৩ সালে পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড (পিআইএফ)-এর সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত ‘বাদায়েল’ কোম্পানি তাদের প্রধান পণ্য তামাকমুক্ত নিকোটিন পাউচ ডিজার্ট-এর মাধ্যমে ব্যাপক ‘তামাকমুক্ত সৌদি আরব’ উদ্যোগ পরিচালনা করছে।
দুই বছরের কম সময়ে, বাদায়েল প্রায় ৪ লাখ ধূমপায়ীকে সিগারেটের ব্যবহার কমাতে সাহায্য করেছে, যার মধ্যে প্রায় ১.৪ লাখ মানুষ সম্পূর্ণভাবে নিকোটিন ত্যাগ করেছে। এই উদ্যোগ সৌদি ভিশন ২০৩০-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা দেশটির উদ্ভাবন এবং ক্ষতি হ্রাসভিত্তিক, তামাকমুক্ত ভবিষ্যতের প্রতি প্রতিশ্রুতিকে প্রতিফলিত করে।
একইভাবে, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) তাদের শিল্প ও উন্নত প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় (এমওআইএটি)-এর মাধ্যমে তামাকমুক্ত ওরাল নিকোটিন পাউচের জন্য প্রযুক্তিগত মান নির্ধারণ করেছে। এই নীতি সরকারের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রতি গুরুত্বকে তুলে ধরে, যাতে প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ীরা নিরাপদ এবং সুশৃঙ্খলভাবে নিয়ন্ত্রিত বিকল্প পণ্যের সুবিধা পেতে পারে।
এই নিকোটিন পাউচগুলোতে কোনো তামাক, ধোঁয়া বা জ্বালানী নেই। ফলে ফুসফুসের ক্যান্সার, হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের মতো গুরুতর রোগের সঙ্গে যুক্ত প্রায় সব ক্ষতিকর রাসায়নিক থেকে মুক্ত এই প্রোডাক্টগুলো। মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের তথ্য থেকে দেখা যায়, সঠিক নিয়ন্ত্রণ থাকলে নিকোটিন পাউচ দাহ্য সিগারেটের তুলনায় ৯৯%-এরও বেশি কম ক্ষতিকর, এবং ২০০৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) যে নয়টি প্রধান বিষাক্ত পদার্থ চিহ্নিত করেছিল, তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত এই প্রোডাক্টগুলো।
সৌদি আরব থেকে ইতিমধ্যেই আশানুরূপ ফলাফল এসেছে। সেখানকার হাসপাতালগুলো জানিয়েছে, ধূমপান-সংক্রান্ত রোগের সংখ্যা কমছে, এবং আরও বেশি মানুষ ধূমপান ত্যাগ করতে এই প্রোডাক্টগুলো ব্যবহার করছে। বাস্তবে, একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিকোটিন পাউচে পরিবর্তন করেছে তাদের ৪১% সফলভাবে ধূমপান ত্যাগ করেছে, যা প্রমাণ করে যে, সহায়ক এবং বৈজ্ঞানিক প্রমাণভিত্তিক নীতি কঠোর নিষেধাজ্ঞার চেয়ে বেশি কার্যকর।
যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) নিকোটিন পাউচের ক্ষতি হ্রাসের সম্ভাবনাকেও স্বীকৃতি দিয়েছে। বিস্তারিত পর্যালোচনার পর, এফডিএ এই বছরের শুরুতে জেডওয়াইএন (ZYN) পণ্যের বিপণন অনুমোদন করেছে।
এফডিএ-র সেন্টার ফর টোবাকো প্রোডাক্টস-এর সায়েন্স অফিসের পরিচালক ড. ম্যাথু ফ্যারেলি বলেছেন, এই নিকোটিন পাউচ পণ্যগুলো অত্যন্ত মানসম্মত। এগুলো সিগারেট বা তামাকজাত পণ্য ব্যবহারকারী প্রাপ্তবয়স্কদের তামাক ছাড়তে সহায়তা করে। তামাক আসক্তরা সম্পূর্ণভাবে এই পণ্যগুলোতে পরিবর্তন করতে পারে।
প্রতিষ্ঠানটি দায়িত্বশীল বিপণন এবং ২১ বছরের নিচে বিক্রয় সীমাবদ্ধ করতে জোর দিয়েছে। যাতে শিশুদের সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়।
এছাড়া, সেন্টার ফর টোবাকো প্রোডাক্টস-এর পরিচালক ড. ব্রায়ান কিং জানান, জনস্বাস্থ্য রক্ষা করতে প্রতিষ্ঠানটি বাজারের দিকে সতর্ক নজর রাখছে এবং একইসঙ্গে তারা জানিয়েছে, তরুণদের এসব পণ্য ব্যবহারের হার এখনও কম।
বাংলাদেশের জন্য নিয়ন্ত্রিত ও বৈজ্ঞানিক প্রমাণভিত্তিক বিকল্প যেমন নিকোটিন পাউচ চালু করলে তা বর্তমান তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতিকে আরও শক্তিশালী করতে পারে এবং দেশের তামাকমুক্ত হওয়ার জাতীয় লক্ষ্যকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে। বাংলাদেশ বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত মোড়ে দাঁড়িয়েছে। এখন উচিত কঠোর নিয়ম আর বিদেশী প্রভাব উপেক্ষা করে প্রমাণভিত্তিক, স্বাস্থ্যকেন্দ্রিক নীতি গ্রহণ করা, যা জনস্বাস্থ্য ও দেশের অর্থনীতি দুটোই ভালো রাখবে।