ঢাকা, বাংলাদেশ

সবার নজর এখন আদালতের দিকে

প্রকাশিত :

বিশেষ প্রতিবেদক : আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রথম বারের মতো দেশের কোনো সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিষয়ে রায় ঘোষণা হবে সোমবার (১৭ নভেম্বর)। এ ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে আগামী বৃহস্পতিবার চূড়ান্ত রায় দেবেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত।

পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিষয়ে জুলাই অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় রায় ঘোষণা করা হবে। যেটি বাংলাদেশ টেলিভিশন সরাসরি সম্প্রচার করবে।


অপরদিকে ২০১১ সালে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেন। পট পরিবর্তনের পর বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বে দেওয়া বাতিলের রায় পুর্নবিবেচনা চেয়ে আবেদন করে বিএনপি, জামায়াত এবং ড. বদিউল আলম মজুমদারসহ ৫ ব্যক্তি। সেই আবেদন আপিলে রূপান্তরিত হয়। এখন ওই আপিলের ওপর ২০ নভেম্বর রায় ঘোষণা করবেন আপিল বিভাগ।

শেখ হাসিনার মামলা
জুলাই অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিষয়ে আগামীকাল সোমবার (১৭ নভেম্বর) রায় ঘোষণা করবেন বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

এর আগে গত ২৩ অক্টোবর শুনানি শেষে রায়ের তারিখ নির্ধারণের জন্য ১৩ নভেম্বর দিন রাখা হয়। এদিন রায় ঘোষণার জন্য ১৭ নভেম্বর দিন ঠিক করা হয়।

শেষ দিনে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান সমাপনী বক্তব্যে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রার্থনা করেন।


চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ১৭ নভেম্বর আদালত তার সুবিবেচনা, প্রজ্ঞা প্রয়োগ করবেন। এ জাতির বিচারের জন্য যে আকাঙ্ক্ষা, যে তৃষ্ণা সেটার প্রতি তারা সুবিচার করবেন। একটি সঠিক রায়ের মাধ্যমে সংঘঠিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি ইতি ঘটাবেন এবং ভবিষ্যতের জন্য রায়টি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তেমন একটি রায় প্রত্যাশা করছি।

আর রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন আসামি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের খালাস প্রার্থনা করেন। তিনি বলেন, সব কিছু মিলিয়ে দালিলিক সাক্ষী বির্তক সৃষ্টি (কন্টোভার্সি ক্রিয়েট) করার চেষ্টা করেছি। বিভিন্ন সময় দালিলিক সাক্ষীর ওপর বির্তক সৃষ্টি হয়েছে বলে আমি বিশ্বাস করি। সব কিছু মিলিয়ে আমি বিশ্বাস করি আমার আসামিদ্বয় খালাস পাবেন।

প্রথমবারের মতো এ মামলার বিচারের অধিকাংশ শুনানির দিনে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছে। মামলার অপর দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।

আদালতে পলাতক দুই আসামির পক্ষে শুনানিতে ছিলেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। আর প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম।

এর আগে গত ১০ জুলাই এ মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। একই সঙ্গে সাবেক আইজিপি মামুন নিজেকে ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী) হিসাবে যে আবেদন করেছেন, তা মঞ্জুর করেন ট্রাইব্যুনাল।

এ মামলায় মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে।

প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, গত বছরের ১৪ জুলাই গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ ও ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ উল্লেখ করে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন শেখ হাসিনা। এর পরিপ্রেক্ষিতে আসাদুজ্জামান খান, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসীরা ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ-নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণ করে। গুলি করে দেড় হাজার ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়। আহত হন প্রায় ২৫ হাজার।

দ্বিতীয় অভিযোগ, হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আইজিপি তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ও অধীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে সেই নির্দেশ কার্যকর করেন। গত বছরের ১৪ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এএসএম মাকসুদ কামাল এবং ১৮ জুলাই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে কথা বলেন শেখ হাসিনা। দুজনের সঙ্গে কথোপকথনের পৃথক অডিও রেকর্ড থেকে জানা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলোকে মারণাস্ত্র ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি।

শেখ হাসিনার সেই নির্দেশ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপির মাধ্যমে সব বাহিনীর কাছে দেওয়া হয়। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও তার অন্যান্য অঙ্গসংগঠন এবং ১৪-দলীয় জোটের কাছেও এই নির্দেশ চলে যায়। সেই নির্দেশের আলোকে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়। এর দায়ে তাদের (হাসিনা, আসাদুজ্জামান ও মামুন) বিরুদ্ধে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির (সর্বোচ্চ দায়) আওতায় অভিযোগ গঠন করা হয়েছে।

তৃতীয় অভিযোগ, রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করার ঘটনায় শেখ হাসিনার পাশাপাশি আসাদুজ্জামান ও মামুনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

চতুর্থ অভিযোগ, রাজধানীর চানখাঁরপুলে আন্দোলনরত নিরীহ-নিরস্ত্র ছয়জনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায়ও শেখ হাসিনার পাশাপাশি ওই দুজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

পঞ্চম অভিযোগ, শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান ও মামুনের বিরুদ্ধে আশুলিয়ায় নিরীহ-নিরস্ত্র ছয়জনকে আগুনে পুড়িয়ে মারার ঘটনায়ও অভিযুক্ত করা হয়েছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার
শুরুটা হয়েছিল ৯০-এর দশকে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে। তখন একটি আসনে উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি ওঠে। ১৯৯৬ সালে জামায়াতে ইসলামী ও আওয়ামী লীগের দাবির মুখে সংবিধানের ১৩তম সংশোধনী হিসেবে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ওই বছর ২৭ মার্চ সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির প্রবর্তন ঘটে।

এ বিধান অনুসরণ করে ১৯৯৬ সালে সপ্তম, ২০০১ সালে অষ্টম এবং ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যে নির্বাচনগুলো নিয়ে তেমন কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে অগণতান্ত্রিক ও সংবিধানবহির্ভূত উল্লেখ করে আইনজীবী এম. সলিমউল্যাহসহ তিন আইনজীবী হাইকোর্টে একটি রিট করেন। শুনানির পর তিন বিচারপতির বৃহত্তর বেঞ্চ ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট রায় দেন। রায়ে বলা হয়, ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধানসম্মত ও বৈধ। এই সংশোধনী সংবিধানের কোনো মৌলিক কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি।

২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট। ওই বছর রিট আবেদনকারীরা হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করেন। ২০১০ সালে আপিলে শুনানি শুরু হয়। আপিল শুনানিতে এ মামলায় অ্যামিকাস কিউরি (আদালতকে সহায়তাকারী) হিসেবে আটজন সংবিধান বিশেষজ্ঞ আইনজীবীর মতামত নেন। বেশিরভাগ আইনজীবী তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দেন। এমনকি সে সময়ের রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পক্ষে মত দেন।

আপিলের শুনানি শেষে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকসহ আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে রায় দেন। এতে প্রধান বিচারপতিসহ চারজন বাতিলের পক্ষে ছিলেন। ২০১১ সালের ১০ মে দেওয়া রায়ে বলা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অর্থাৎ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী আইন অগণতান্ত্রিক এবং তা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ফলে তা বাতিলযোগ্য। তবে প্রয়োজনের নিরিখে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে। এই রায় ঘোষণার সাতদিন পর অর্থাৎ ১৭ মে অবসরে যান এ বি এম খায়রুল হক। অবসরে যাওয়ার প্রায় ১৬ মাস পর ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়। তখন সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের বিরুদ্ধে রায় পরিবর্তনের অভিযোগ ওঠে। পূর্ণাঙ্গ রায় থেকে ‘তবে প্রয়োজনের নিরিখে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে’ এই পর্যবেক্ষণ বাদ দেওয়া হয়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেওয়া রায়ের পক্ষের বাকি তিন বিচারপতি যথাক্রমে প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন। তবে ভিন্নমত পোষণকারীরা প্রধান বিচারপদি হতে পারেননি। এই রায়ের পর সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক প্রথা বিলোপ করেন। আর তারপরই তিনটি নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে করে একতরফাভাবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ধরে রাখে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। দ্বাদশ নির্বাচনের ছয় মাস পরে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী সরকারের পতন হয়।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে ২০১১ সালের বিতর্কিত রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে গত বছর ২৭ আগস্ট আবেদন করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ ব্যক্তি। পরে ১৭ অক্টোবর আবেদন করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ২৩ অক্টোবর আরেকটি আবেদন করেন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। এ ছাড়া নওগাঁর রানীনগরের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেনসহ আরও দুটি আবেদন করা হয়।

রিভিউ আবেদনের শুনানি শেষে গত ২৭ আগস্ট প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির বেঞ্চ আপিলের অনুমতি দেন। বর্তমানে সে আপিলের ওপর শুনানি শেষে রায়ের জন্য ২০ নভেম্বর দিন রেখেছেন আপিল বিভাগ।

বিএনপির পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, আমি আদালতে বলেছি— যে রায় দেন না কেন, রায়টা যেন পরবর্তী সময় থেকে কার্যকর হয়। ২০২৬ এর নির্বাচন এ রায়ের অধীনে হবে বলে মনে করি না। এ ধরনের রায়ের কার্যকারিতা সবসময় পরবর্তী সময় থেকে কার্যকর হয়। সেই হিসেবে এই অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের (ফেব্রুয়ারি ২০২৬) ওপর রায়টি প্রভাব বিস্তার করবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রায়টি কার্যকর হবে ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পর গঠিত সংসদের পরের নির্বাচন থেকে।

তিনি আরও বলেন, আদালতে বলেছি— অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন মানুষের মৌলিক দাবি। গণতন্ত্রকে সমুন্নত করার জন্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার হচ্ছে আমাদের সংবিধানের মৌলিক কাঠামো। অতএব এই মৌলিক কাঠামো সন্নেবিশত ছিল। সুতরাং বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থি অজুহাতে তত্ত্বাবধায়কের সংশোধনীটা যে বাতিল করেছিলেন, সেটি পুনর্বিবেচনা করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সংবিধানে ফিরিয়ে আনুন। আদালতকে বলেছি, বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের রায়টা সম্পূর্ণভাবে বাতিল করে আপিলটা যদি মঞ্জুর করে যে রায় দেবেন সেটি হবে চূড়ান্ত রায়। যদি আপিল মঞ্জুর করে রায় দেন তাহলে খায়রুল হকের রায় বাতিল হয়ে নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা আমাদের সংবিধানে পুনরুজ্জীবিত হবে।

জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচনের জন্য ৩৬ বছর পরে এসে এটিই একটি গ্রহণযোগ্য ফর্মুলা। আমরা বলেছি, আপিল মঞ্জুর করা উচিত। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল করা উচিত। কিন্তু তার সাথে কোনো পর্যবেক্ষণ দেওয়া উচিত না। যেহেতু একটা বৃহৎ সংস্কার প্রক্রিয়া চলমান। জুলাই সনদ হয়েছে। গণভোট হবে এবং পরবর্তী সংসদে এটি নিয়ে আলোচনা হবে। এ জন্য এটিকে কেন্দ্র করে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক সুনির্দিষ্ট কোনো পর্যবেক্ষণ থাকা উচিত না। বরং এ আপিলটা মঞ্জুর হবে নাকি খারিজ হবে, এটাই হওয়া উচিত নিষ্পত্তির মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। এখানে যদি বাড়তি কোনো অবজারবেশন থাকে, কোনো নির্দেশনা থাকে, তাহলে ইতোমধ্যে জুলাই সনদ এবং সংসদে উপস্থাপনের জন্য যে প্রস্তাবে রাজি হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো, সে বৃহত্তর সংস্কার প্রক্রিয়া কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

তিনি আরও বলেন, আমরা বলেছি সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা কী হবে সেটাও একটা আলোচনার বিষয়। এ ব্যাপারে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছেন। এটিও আগামী গণভোটে উপস্থাপন করা হচ্ছে। যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে এখানে কোনো অবজারভেশন দেওয়া ঠিক হবে না।

তত্ত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থা কার্যকর করা নিয়ে শিশির মনির বলেন, এটি মঞ্জুর হলেও এখন কার্যকর করা সম্ভব না। কারণ যে সিস্টেমে এটা প্রয়োগ করতে হয়, সেটি (সংসদ বহাল থাকা অবস্থায়) এখন বাংলাদেশে নেই। এটা বহাল করা হলে যখন পরিস্থিতি আসবে তখন প্রয়োগ হবে। বর্তমানে সংসদ নেই তাই সংসদ ভাঙারও কোনো প্রশ্ন নেই। সংসদ না ভাঙলে তত্ত্বাবধায়ক গঠনের সুযোগ নেই। অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন করবে। নতুন সংসদ হবে। নতুন সংসদের সিদ্ধান্তে যদি আগের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আগের মতোই থেকে যায় অথবা নতুন করে জুলাই সনদে উল্লিখিত মেকানিজম যুক্ত করা হয়, তাহলে সেই পদ্ধতিতে পরবর্তী থেকে তত্ত্বাবধায়ক কার্যকর হবে।

রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ওই রায় (তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের দেওয়া রায়) থাকা উচিত না। কারণ কোনো একটি রাজনৈতিক দলকে সুবিধা দেওয়ার জন্য রায়টি লেখা হয়েছিল। এটি এই সরকারের পরে যে সরকার আসবে, সেখান থেকে কার্যকর করা হলে আইনের কোনো ব্যত্যয় হবে না।

জুলাই সনদে আইনজীবী শিশির মনিরের সুপারিশ করা তত্ত্বাবধায়কের পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, প্রত্যেক আইনজীবীর নিজস্ব সাবমিশন থাকে। মক্কেলের ইনস্ট্রাকশন থাকে। শিশির মনির সাহেব যে অবজারভেশন দিয়েছেন, সেটা ওনার বিষয়। এটা নিয়ে আমার কমেন্ট করার সুযোগ নেই।

তবে গত ২৭ আগস্ট অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছিলেন, বাংলাদেশের মানুষকে দীর্ঘস্থায়ী গণতন্ত্রের পথে নেওয়ার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় ফিরতে হলে সেটা কখন থেকে কী ফরমেটে আসবে, তা আপিল বিভাগ সিদ্ধান্ত দেবেন। প্রধান বিচারপতিও মনে করেন, এর একটি কার্যকর সমাধান হওয়া উচিত। আমরাও মনে করি, এর একটা কার্যকর সমাধান হওয়া উচিত।

বদিউল আলম মজুমদারসহ ৫ জনের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শরীফ ভুঁইয়া বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে আসলে বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারে ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না। বর্তমান সরকার গঠিত হয়েছে ভিন্ন সাংবিধানিক ব্যবস্থায়। এটা লিখিত কোনো অনুচ্ছেদের অধীনে গঠিত হয়নি। এটা গঠিত হয়েছে বিপ্লব পরবর্তী জনগণের আকাঙ্ক্ষায় । সরকার পালিয়ে যাওয়ায় শূন্যতা হওয়ার কারণে গঠিত হয়েছে। ওনারা দেশ পরিচালনা, সংস্কার করা ও নির্বাচন করার ম্যান্ডেট পেয়েছেন। এটা করে বিদায় নেবেন। এটার সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরা না ফেরার সম্পর্ক নেই। রায়ে ফিরে আসলেও এখন ত্রয়োদশ সংশোধনী অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা গঠন করার সম্ভব না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা গঠন করা সম্ভব হবে ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পর গঠিত সংসদ ভেঙে গেলে।

তিনি আরও বলেন, বিচারপতি খায়রুল হকের রায় যদি আপিল বিভাগ বাতিল করেন, তাহলে কি আপনা আপনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানের অংশ হয়ে যাবে নাকি রায়ের ভিত্তিতে সংসদে একটা আইন করতে হবে— এ ব্যাপারে কিছু কনফিউশন আছে। অষ্টম সংশোধনী ও ষোড়শ সংশোধনীর মামলার নজির দেখিয়েছি। এটা আমাদের প্রতিষ্ঠিত আইনে আছে যে, কোনো কিছু বাতিল হলে আগেরটা আপনা আপনি পুনরুজ্জীবিত হবে। যদি আদেশের মাধ্যমে পুনরুজ্জীবিত হয় তাহলে সংসদের ক্ষমতা খর্ব হবে না। রায় দিলেও বর্তমান নির্বাচন অন্তর্বর্তী সরকার করবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পরের নির্বাচন অর্থাৎ চতুর্দশ সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে কার্যকর হবে। আমি বলেছি, রায়ে এটা স্পষ্ট করে দিতে পারেন।

১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের চতুর্থ ভাগের ২ক পরিচ্ছেদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে ৫৮(খ), ৫৮(গ), ৫৮(ঘ) ও ৫৮(ঙ) অনুচ্ছেদ যুক্ত করা হয়। ওই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, সংসদ ভেঙে গেলে বা মেয়াদ শেষ হলে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে। এই সরকারের মেয়াদ হবে অনধিক ৯০ দিন।

বাতিল হওয়া তত্ত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থা হলো, প্রধান উপদেষ্টা ও অনধিক ১০ জন উপদেষ্টা নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে। আর প্রধান উপদেষ্টা হবেন সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি। যদি তিনি সম্মত না হন, তবে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিদের মধ্য থেকে বয়সে জ্যেষ্ঠতম যিনি, তিনি হবেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনিও সম্মত না হলে আপিল বিভাগের সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের মধ্য থেকে বয়সে জ্যেষ্ঠতম জন প্রধান উপদেষ্টা হবেন। যদি এই পদ্ধতিগুলো ব্যর্থ হয়, তবে রাষ্ট্রপতি প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের জন্য উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে পরামর্শ করে অগ্রসর হবেন। প্রধান উপদেষ্টা কর্তৃক অনধিক ১০ জন উপদেষ্টাকে নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করা হতো। যদি কোনো প্রক্রিয়াতেই প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ সম্ভব না হতো, তবে রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের বিধান ছিল। আর উপদেষ্টা হওয়ার যোগ্যতায় বলা ছিল, একজন ব্যক্তিকে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পেতে হলে তার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা থাকতে হবে। তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য বা রাজনৈতিক দলের কোনো অঙ্গসংগঠনের সদস্য হবেন না। আসন্ন সংসদ নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হবেন না মর্মে লিখিতভাবে সম্মত হতে হতো। আর প্রধান উপদেষ্টা বা উপদেষ্টাদের বয়স ৭২ বছর পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল।

আর সংসদ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর নতুন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্বভার গ্রহণ করলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিলুপ্তি ঘটবে। প্রধান উপদেষ্টা যদি রাষ্ট্রপতিকে জানাতেন যে কোনো উপদেষ্টা দায়িত্ব পালনে অক্ষম, তবে রাষ্ট্রপতি তাকে অপসারণ করতে পারবেন।

গত ১৭ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকারের দেওয়া ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ এর ১৬ ধারায় নির্বাচনকালীন নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদ সংশোধন করে এবং ৫৮(খ), ৫৮(গ), ৫৮(ঘ) ও ৫৮(ঙ) অনুচ্ছেদ হিসেবে নতুন করে যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে সনদে। সংসদের মেয়াদ অবসানের কারণে অথবা অন্য যে-কোনো কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ (নব্বই) দিনের মধ্যে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

পদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়, সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ১৫ দিন আগে এবং অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে গেলে, ভেঙে যাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত করতে হবে। আর প্রধান উপদেষ্টা বাছাইয়ে একটি বাছাই কমিটি রাখা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৩০ দিন আগে এই কমিটি গঠিত হবে। জাতীয় সংসদের স্পিকারের তত্ত্বাবধানে এবং সংসদ সচিবালয়ের ব্যবস্থাপনায় এটি গঠিত হবে। কমিটি গঠনের ১৪ দিনের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা পদের জন্য ব্যক্তি বাছাই করতে হবে।

কমিটির সদস্য সংখ্যা হবে পাঁচজন। এতে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার (বিরোধী দলের) ও সংসদের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দলের একজন প্রতিনিধি। কমিটির যেকোনো বৈঠক ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সভাপতিত্ব করবেন স্পিকার। উপদেষ্টাদের বয়সসীমা ৭৫ বছরে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে।

সনদে আরও বলা হয়েছে, এই পদ্ধতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বেছে নেওয়া সম্ভব না হলে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অনুসরণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রেও শর্ত দেওয়া হয়েছে, রাষ্ট্রপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে বেছে নেওয়া যাবে না। যদিও প্রধান উপদেষ্টা এবং উপদেষ্টা হওয়ার যোগ্যতা ধরা হয়েছে ত্রয়োদশ সংশোধনীর ৫৮গ অনুচ্ছেদ অনুসারে। তবে জুলাই সনদের ৩ ধারা বা অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংক্রান্ত ৫৮ক, ২ক পরিচ্ছেদ (৫৮খ, ৫৮গ, ৫৮ঘ ও ৫৮ঙ অনুচ্ছেদ) সংবিধানে যুক্ত হবে, তা সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের প্রয়োজন হবে।