ঢাকা, বাংলাদেশ

আটকে আছে টেলিটকের ফোরজি সম্প্রসারণ প্রকল্প

প্রকাশিত :

নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলাদেশ-চীন সহযোগিতার আওতায় ইউনিয়ন পর্যায়ে টেলিটকের ফোরজি নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ প্রকল্পটি ৮ বছরেরও বেশি সময় ধরে স্থবির হয়ে পড়ে আছে। জানা গেছে, আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ ও প্রশাসনিক অদক্ষতার কারণে প্রকল্পটি কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, এই দীর্ঘসূত্রতা শুধু দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় মোবাইল অপারেটরকেই দুর্বল করে দিচ্ছে না, বরং ঢাকা-বেইজিং কূটনৈতিক সম্পর্কেও প্রভাব ফেলতে পারে।

চীনা সরকারের কনসেশনাল লোন (জিসিএল) তহবিলের আওতায় নেওয়া এই প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল সারাদেশে তিন হাজার ২০০টি বেস ট্রান্সসিভার স্টেশন (বিটিএস) স্থাপন। এর মধ্যে নতুন টাওয়ার থাকবে দুই হাজার এবং সংস্কার হবে বাকি এক হাজার ২০০টি টাওয়ার।


এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল সারা দেশে টেলিটকের ফোরজি সেবা শক্তিশালী করা এবং গ্রাম-শহরের ডিজিটাল বৈষম্য কমানো।


তবে কর্মকর্তাদের দাবি, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ও ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের (পিটিডি) অতিরিক্ত হস্তক্ষেপের কারণে দরপত্র প্রক্রিয়া অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে, যা দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার মূল উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করছে।

২০১৭ সালে ইআরডির এক সার্কুলারের পর চীনা সরকারের মনোনীত তিনটি প্রতিষ্ঠান ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দরপত্র জমা দেয়। কিন্তু ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে টেন্ডার ইভ্যালুয়েশন কমিটি (টিইসি) প্রস্তাবগুলোকে ‘প্রযুক্তিগতভাবে অগ্রহণযোগ্য’ ঘোষণা করে একই দরদাতাদের মধ্যে পুনরায় দর আহ্বানের সুপারিশ করে। টেলিটকের বোর্ড প্রস্তাবটি অনুমোদন করে এবং কেন্দ্রীয় ক্রয় কারিগরি ইউনিট (সিপিটিইউ) জানায় যে এটি ২০০৮ সালের পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলসের ধারা ৩৪ অনুযায়ী বৈধ।

তবে কেন্দ্রীয় ক্রয় কারিগরি ইউনিট একটি অস্বাভাবিক শর্ত জুড়ে দেয়। তারা ইআরডির সঙ্গে পরামর্শ নেওয়ার কথা বলে, যা চীনা সরকারের বিশেষ ঋণ প্রকল্পের জন্য বাধ্যতামূলক না।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ বা ইআরডি বেইজিংয়ের সঙ্গে আলোচনা না করে বরং দরদাতার সংখ্যা পাঁচ থেকে আটে বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়। এতে কার্যত চীনের মনোনয়ন ক্ষমতা বাতিল হয়ে যায় এবং লঙ্ঘিত হয় কনসেশনাল ঋণের শর্ত।

একজন জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এই পদক্ষেপ দ্বিপক্ষীয় কাঠামোর পরিপন্থী। এতে চীনের আস্থা ক্ষুণ্ণ হতে পারে এবং ভবিষ্যৎ সহযোগিতা প্রকল্পগুলো ঝুঁকিতে পড়তে পারে।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর অভিযোগ, টেলিটকের নেটওয়ার্ক সরবরাহের নিয়ন্ত্রণ একটি নির্দিষ্ট প্রস্ততকারকের হাতে তুলে দিতে লবিং করছে একদল প্রভাবশালী ব্যক্তি। এমনটা হলে স্বাভাবিক প্রতিযোগিতা ব্যাহত করবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে টেলিটকের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা একটি সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠান, বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছি। অথচ আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আমাদের অগ্রগতি ধীর করে দিচ্ছে। আমরা এসব বাধা পেরিয়ে জনগণকে মানসম্মত সেবা দিতে চাই।’

টেলিকম বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, এই প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ অব্যাহত থাকলে দ্বিপক্ষীয় ঋণ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

নীতিনির্ধারক পর্যায়ের টেলিকমের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘চীন এসব প্রকল্পকে সরকারে-সরকারে প্রতিশ্রুতি হিসেবে বিবেচনা করে। যদি বাংলাদেশ নিজেই সেই নীতিমালা উপেক্ষা করে, তাহলে পারস্পরিক আস্থার অবনতি ঘটবে। ফলে ভবিষ্যতে চীনা অর্থায়নের প্রকল্পগুলো থমকে যেতে পারে।’

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) একজন কর্মকর্তা এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল মাবুদ চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

বর্তমানে টেলিটক সারা দেশে প্রায় ৬ হাজার সক্রিয় বিটিএস সাইট পরিচালনা করছে। এই নেটওয়ার্ক ৬৪টি জেলা, ৪৯০টি উপজেলা এবং প্রায় ২,৫০০ ইউনিয়নজুড়ে বিস্তৃত। তবে অনেক গ্রাম ও দুর্গম অঞ্চলে ফোরজি সংযোগ এখনও সীমিত আকারে রয়েছে, সেখানকার ব্যবহারকারীরা সাধারণত থ্রিজি বা টুজি নেটওয়ার্কের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হচ্ছেন।