মাছের জন্য ধান চাষ, দিনে কোটি টাকা আয়
সবুজ ধানখেতজুড়েই পানি। এর মধ্যে খেতের আইলে চাঁই পেতে চাষিরা তুলছেন কোরাল, চিংড়ি ও চিরিংয়ের মতো সামুদ্রিক মাছ। চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের সবুজচরে এই দৃশ্য এখন প্রতিদিনের। সরকারি নিষেধাজ্ঞায় সাগরে মাছ ধরা বন্ধ থাকলেও সবুজচরের ধানখেত থেকেই প্রতিদিন আহরিত হচ্ছে প্রায় কোটি টাকার মাছ। চাষিরা জানান, মাছ চাষের জন্যই তাঁরা মূলত এই চরে ধান চাষ করে আসছেন। এতে কম পরিশ্রমে বেশি লাভ হচ্ছে।
চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শীত মৌসুমে এই সবুজচর শুষ্ক থাকে। চৈত্র মাসের শেষ থেকে জোয়ারের পানিতে চর ধীরে ধীরে প্লাবিত হয়। এ সময় জোয়ারের পানির সঙ্গে সামুদ্রিক মাছও চরটিতে আসে। এসব মাছ চরে জমে থাকা পানিতে ডিম দেয়। জ্যেষ্ঠ মাস শুরুর পর থেকে এসব ডিম ফুটতে শুরু করে। আমন ধানের চাষ শুরু হলে ধানের সঙ্গে মাছগুলোও বড় হয়। বর্ষা শেষ হতেই এসব মাছ ধরা শুরু হয়। এরপর এসব মাছ নেওয়া হয় স্থানীয় একতা বাঁধ বাজারে। সেখানে উৎসবমুখর পরিবেশে চলে বেচাবিক্রি।
সরেজমিনে গত বৃহস্পতিবার এবং গতকাল শুক্রবার ভোরে সন্দ্বীপের দীর্ঘাপাড়ের একতা বাঁধ এলাকায় দেখা যায়, চাষিরা ঝাঁকে ঝাঁকে কোরাল, চিংড়িসহ সামুদ্রিক নানান মাছ নিয়ে আসছেন হাটে। উপজেলার প্রতিটি বাজারের মাছ ব্যবসায়ীও ভিড় করছেন এই হাটে। স্থানীয় পাইকারদের পাশাপাশি পরিবারের জন্য মাছ কিনতেও ছুটে আসছেন হাজারো মানুষ।
সবুজচর দেশের আমন ধানের অন্যতম ভান্ডার। তবুও এখানকার চাষিরা ধানের জন্য নয়; বরং মাছের জন্য ধান চাষ করেন।
—নিজাম উদ্দিন, চাষি
স্থানীয় চাষি নুর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাগরে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময়ে ধানের জমি থেকে ধরা এসব মাছ আমাদের জন্য নিয়ামত। এতে একদিকে মানুষের চাহিদা মিটছে, আরেক দিকে কৃষকেরাও লাভবান হচ্ছেন।’ নিজাম উদ্দিন (৬০) নামের আরেক চাষি বলেন, ‘সবুজচর দেশের আমন ধানের অন্যতম ভান্ডার। তবুও এখানকার চাষিরা ধানের জন্য নয়; বরং মাছের জন্য ধান চাষ করেন।’
মাছের বাজারে ক্রেতা–বিক্রেতার ভিড়। সম্প্রতি সন্দ্বীপের দীর্ঘাপাড়ের একতা বাঁধ এলাকায়
মাছের বাজারে ক্রেতা–বিক্রেতার ভিড়। সম্প্রতি সন্দ্বীপের দীর্ঘাপাড়ের একতা বাঁধ এলাকায়ছবি: প্রথম আলো
মাছেই আয় কোটি টাকা
সন্দ্বীপের এই সবুজচর ‘রাজাশাইল’ ধান উৎপাদনের জন্য খ্যাত। কারণ, এ ধানই দ্বীপটিতে ভালো ফলে। প্রায় পাঁচ হাজার হেক্টর জমিতে সাড়ে তিন হাজার কৃষক এই ধান চাষে যুক্ত। ধানের জমির আইলে চাঁই ও স্থানীয় ‘বিন্দি জালের’ ফাঁদ পেতে মাছ ধরেন চাষিরা।
চাষি ও দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্ষা মৌসুম শেষ হওয়ার পর প্রতিদিন নানান আকারের কোরাল, চিংড়ি, ট্যাংরা, বাটা ও চিরিং মিলিয়ে বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টন মাছ। এর মধ্যে প্রতি কেজি চিরিং মাছ ৪০০ থেকে ৬০০, চিংড়ি ৫০০ এবং কোরাল ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা কেজিতে খুচরায় বিক্রি হচ্ছে। সেই হিসাবে দৈনিক বিক্রি হয় প্রায় এক কোটি টাকার মাছ।
জাহাঙ্গীর আলম নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভোর ছয়টা থেকে এ মাছের জমজমাট বেচাকেনা শুরু হয়। চলে সকাল নয়টা পর্যন্ত। এ সময় বিরতিহীনভাবে হাজার মণ মাছের হাতবদল হয়। দোকানি মো. জাহেদ (২২) বলেন, ‘বেচাবিক্রির সঠিক হিসাব কেউ রাখেন না, তবে মাছের দাম আর বিক্রির গতি দেখে অনুমান করা যায় প্রতিদিন কোটি টাকা বিক্রি হয়।’
ডোবাচরের চাষি জামাল উদ্দিন (৫৪) প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর তিন হেক্টর জমিতে আমন চাষে খরচ হয় দুই লাখ টাকা। ধান আর খড় বিক্রি করেই এ টাকা ওঠে। এ জমির মাছ বিক্রি করে আরও কয়েক লাখ টাকা পাওয়া যায়। মাছ বিক্রির টাকার পুরোটাই তাঁর লাভ।
খেতের আইলে চাঁই বসিয়ে মাছের জন্য অপেক্ষা করছেন এক চাষি। সম্প্রতি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের সবুজচরে
খেতের আইলে চাঁই বসিয়ে মাছের জন্য অপেক্ষা করছেন এক চাষি। সম্প্রতি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের সবুজচরেছবি: প্রথম আলো
কোথায় যায় এসব মাছ
দোকানিরা জানান, সবুজচরে যে মাছ আহরণ করা হয়, তা নোয়াখালী হয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যায়। প্রতিদিনই নোয়াখালীসহ বিভিন্ন অঞ্চলের পাইকাররা এ বাজারে আসেন। এরপর বাক্সে করে এসব মাছ ট্রলারে তোলা হয়।
বাজারে আসা আলাউদ্দিন নামের এক শ্রমিক প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এক ব্যবসায়ীর হয়ে মাছ নিতে এসেছেন। শুক্রবার তিনি একটি ট্রলারে করে ৭০ মণ মাছ নোয়াখালীতে পাঠিয়েছেন।
চাষিরা জানান, সবুজচরে মাছ সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। এই ব্যবস্থা করা গেলে চাষিরা আরও লাভবান হতেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মংচিংনু মারমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি সম্পর্কে তিনি বিস্তারিত জানেন না। বিস্তারিত জেনে তিনি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য মৎস্য কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেবেন। পরে বিধি মোতাবেক প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মারুফ হোসেন বলেন, ‘সবুজচরের বিস্তৃত আমন ভান্ডারের ধান ও মাছে কৃষককে আরও লাভবান করতে একটি সমন্বিত সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। কৃষি বিভাগ থেকে আমরা এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে প্রস্তুত। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’