কৃষি মন্ত্রণালয়ের হাতে যাচ্ছে পুরো নিয়ন্ত্রণ
নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশে সার বিতরণে ডিলার নিয়োগের কার্যক্রম এতদিন বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) ও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) অধীন ছিল।
দেশে সার বিতরণে ডিলার নিয়োগের কার্যক্রম এতদিন বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) ও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) অধীন ছিল। ‘সার ডিলার নিয়োগ ও সার বিতরণসংক্রান্ত সমন্বিত নীতিমালা ২০০৯’-এর অধীনে সংস্থা দুটি সারা দেশে ডিলারশিপ নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করত। সম্প্রতি এ কার্যক্রম পুরোপুরি কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতায় নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ-সংক্রান্ত একটি নীতিমালা অনুমোদন দেয়া হয়েছে, যা চূড়ান্ত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। সেই সঙ্গে সারের বর্তমান ডিলারশিপ সংখ্যা বাড়িয়ে প্রায় দ্বিগুণ করার পরিকল্পনাও নেয়া হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সার বিতরণে শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতা আনতে এ উদ্যোগ সুফল দেবে। তবে এ বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন সার ডিলারদের সংগঠন-সংশ্লিষ্টরা। নতুন ডিলারশিপ নিয়োগকে কেন্দ্র করে কোনো সংকট সৃষ্টি হলে তা সার সরবরাহ চেইনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ডিলারদের অনেকে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিগত সরকারের সময়ে সার বিতরণে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি, রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে ডিলার নিয়োগের ঘটনা ঘটেছে। অনিয়ম, সংকট দূর করতে কৃষি মন্ত্রণালয়কে সার বিতরণের পুরো দায়িত্ব দিয়ে নতুন নীতিমালা অনুমোদন দিয়েছে সারসংক্রান্ত জাতীয় সমন্বয় ও পরামর্শক কমিটি। নতুন ডিলার নিয়োগের মাধ্যমে প্রান্তিক পর্যায়ে সারের সরবরাহ ব্যবস্থাপনা নিরবচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। যদিও বিভিন্ন জেলার ডিলাররা নতুন নীতিমালার বিরোধিতা করছেন। নতুন ডিলার নিয়োগের বিষয়ে বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএ) আন্দোলনও করছে। তবে কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, সার নিয়ে যেন কেউ অনিয়ম করতে না পারে সেজন্য এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
বিএডিসি ও বিসিআইসির তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে সারের ডিলারশিপ রয়েছে মোট ৭ হাজার ১৫০টি। এর মধ্যে বিসিআইসির আওতাধীন ডিলার রয়েছে ২ হাজার ১১৮ জন আর বিএডিসির আওতাধীন ৫ হাজার ২২ জন। বর্তমানে দেশে প্রতিটি ইউনিয়নে একজন করে ডিলার থাকার বিধান রয়েছে।
নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, বিদ্যমান ডিলারের সংখ্যা বাড়িয়ে প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার করা হবে। যদিও ডিলারের চূড়ান্ত সংখ্যাটা তাৎক্ষণিকভাবে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে জানা যায়নি। নতুন নীতিমালায় প্রতিটি ইউনিয়নে তিনজন ডিলার নিয়োগ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। সার বিতরণকারী ডিলারদের সংগঠনের নেতারা বলছেন, ডিলারের সংখ্যা বাড়ানো হলে সীমিত মুনাফা ভাগাভাগি হয়ে যাবে। এতে বর্তমান ডিলারদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। তাছাড়া অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে, তাতে ব্যয় বাড়বে। এতে ডিলাররা চাপ সামাল দিতে না পারলে সার সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা করছেন তারা।
জানা গেছে, সার নিয়ে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারী চক্র ভাঙতে ‘সার ডিলার নিয়োগ ও সার বিতরণ-সংক্রান্ত সমন্বিত নীতিমালা ২০০৯’ সংশোধন করা হয়েছে। এরই মধ্যে সারবিষয়ক জাতীয় সমন্বয় ও পরামর্শক কমিটির সভায় এ নীতিমালা অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এখন শব্দগত ও ছোটখাটো কোনো সংশোধন প্রয়োজন কিনা সেটি যাচাই হচ্ছে বলে কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। যাচাই শেষে সংশোধিত নীতিমালা গেজেট আকারে প্রকাশ হবে।
নতুন নীতিমালায় অনিয়মকারী ডিলারের লাইসেন্স বাতিলের বিধান থাকছে। বিএডিসির ও বিসিআইসির হাত থেকে ডিলারশিপ বিতরণের অধিকার যাচ্ছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘ডিলার বাড়ানোর সরকারের এ উদ্যোগ ইতিবাচক। তবে এর ফলাফল নির্ভর করছে বাস্তবায়নের ওপর। স্বচ্ছভাবে এ নীতি বাস্তবায়ন হলে কৃষক উপকৃত হবে বলেই আশা করা যাচ্ছে। কারণ ডিলার বাড়লে কৃষকের জন্য অ্যাকসেসও বাড়বে। বিসিআইসি সার আমদানি করে। তাদের কাজ তো আমদানি করা না। তাদের কাজ উৎপাদন করা। আগে আমাদের চাহিদার ৮০ শতাংশ ইউরিয়া বিসিআইসি উৎপাদন করত। এখন সেই উৎপাদন চাহিদার ২০ শতাংশে নেমে এসেছে। সার আমদানির প্রয়োজন হলে সেটি করবে কৃষি মন্ত্রণালয়। কারণ কৃষির সফলতা-ব্যর্থতার ভার মন্ত্রণালয়কে নিতে হয়। ডিলারশিপ বিসিআইসি থেকে মন্ত্রণালয়ের কাছে নেয়া ভালো হয়েছে বলেই মনে করছি।’
নতুন নীতিমালায় এক পরিবারে একাধিক ডিলারশিপ পাওয়ার সুযোগ থাকবে না। এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘বিগত সময়ে সারের ডিলারশিপ নিয়োগে একটি রাজনৈতিক প্রভাব ছিল। গ্রামাঞ্চলে সার নিয়ে বড় ধরনের রাজনীতি হয়। সেজন্য ডিলারশিপ নিয়োগে এক ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব ছিল। রাজনৈতিক সরকারের সময় দলীয় প্রভাবশালীরা সেই সুবিধা নিয়ে থাকে। কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মাঠ পর্যায়ে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা নেই। সরকার চায় ডিলার নিয়োগ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে। যারা আবেদন করবে এবং যাচাই কমিটি যাদের যোগ্য মনে করবে সরকার তাদের ডিলারশিপ দিতে চায়। সেজন্য রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে এ সরকারের সময়েই ডিলারশিপ দেয়ার চিন্তা হচ্ছে।’
এতদিন ইউরিয়া সার বিতরণ করতেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বিসিআইসির ডিলাররা। নন-ইউরিয়া সার (ডিএপি, টিএসপি, এমওপি) দেয় বিএডিসির ডিলার। এতে কৃষকদের আলাদা আলাদা জায়গায় গিয়ে সার সংগ্রহ করতে হয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ডিলারশিপ আনার পাশাপাশি একই ডিলারের অধীনে ইউরিয়া ও নন-ইউরিয়া বিতরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অনেক কর্মকর্তা বলছেন, নতুন নীতিমালার এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে সার সরবরাহ সহজ ও স্বচ্ছ হবে। অনিয়ম-দুর্নীতি কমে আসবে। পাশাপাশি একটি দপ্তরের অধীনে থাকায় সহজ হবে মনিটরিং।
সারের ডিলারদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএ)’। গত ২৪ জুলাই বিএফএর কমিটি ভেঙে দিয়ে সেখানে প্রশাসক নিয়োগ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে যায় বিএফএ। এ বিষয়ে বিএফএর সর্বশেষ চেয়ারম্যান (কমিটি বিলুপ্ত করায় পদ হারিয়েছেন) মো. ওয়ালিউর রহমান বলেন, ‘এতদিন প্রতি ইউনিয়নে একজন ডিলার ও প্রতিটি ওয়ার্ডের জন্য একজন করে খুচরা বিক্রেতা ছিল। তার পরও সার নিয়ে বিভিন্ন সংকট তৈরি হয়েছে। এখন তিনজন করে ডিলার নিয়োগ দেয়া হবে। এতে ডিলাররা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। খুচরা বিক্রেতাও থাকছে না। ফলে কৃষকের সার সংগ্রহের প্রক্রিয়া আরো কঠিন হবে। আমরা চাচ্ছি আগের ২০০৯ নীতিমালার আলোকে ডিলাররা চলুক। যারা অনিয়ম ও কারসাজি করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমরাও বলছি। তাই বলে যারা সৎভাবে ব্যবসা করছে এবং সময়মতো সার পৌঁছে দিচ্ছে তাদের ক্ষতিতে ফেলা হচ্ছে কেন?’
তিনি আরো বলেন, ‘নতুন ডিলার নিয়োগে অনিয়ম হওয়ার শঙ্কা আছে। সরকার স্বচ্ছভাবে ডিলারশিপ দিতে পারবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। নির্বাচনের আগে সরকার কেন নতুন ডিলার নিয়োগ দিচ্ছে সেটি দেখতে হবে। তারা বিএফএর কমিটি বাতিল করেছে। আমরা আদালতে গিয়েছি। সার ব্যবসায়ীদের দেখভাল আমরাই করব। এখানে কেন প্রশাসক বসবে? আমরা তো পালিয়ে যাইনি।’
অবশ্য এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের প্রধান, অধ্যাপক এএইচএম সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ডিলারের সংখ্যা বাড়লে প্রতিযোগিতা বাড়বে। মনোপলি থাকবে না। একজন সংকট তৈরি করলে অন্যজনের কাছে পাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। তবে ডিলার নিয়োগ প্রক্রিয়া সঠিকভাবে মেইনটেইন করা কিছুটা কঠিন। স্বচ্ছভাবে এটি করতে পারলে কৃষক উপকৃত হবে।’
চলতি বছর দেশে সারের চাহিদা প্রায় ৭০ লাখ টন। সরকারের পক্ষ থেকে সারের সংকট নেই বলা হলেও চলতি আমন মৌসুমে দেশের বিভিন্ন জেলায় পর্যাপ্ত সার না পাওয়ার অভিযোগ ছিল। তবে বেশি দাম দিলে ঠিকই সার পেয়েছেন কৃষকরা। এ সংকটকে ‘কৃত্রিম’ বলছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তবে এমন বেশ কয়েকটি ঘটনার পেছনে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবও ছিল বলে জানিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তদন্তেও বিভিন্ন জায়গায় ডিলারদের কারসাজির বিষয়টি উঠে এসেছে। অনিয়ম ও কারসাজিতে যুক্ত ডিলারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার ব্যবস্থাপনা ও উপকরণ বিভাগের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) আহমেদ ফয়সল ইমাম বলেন, ‘দেশে সারের কোনো সংকট নেই। তবে অনেক জায়গায় কৃষকদের অতিরিক্ত দামে সার কিনতে বাধ্য করা হয়েছে। সেসব জায়গায় আমরা মোবাইল কোর্টসহ বিভিন্নভাবে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। কোথাও কোথাও ডিলাররা সার বিতরণে অনিয়ম করেছেন। এমন অনিয়মে জড়িত দুই হাজারের বেশি ডিলারের ডিলারশিপ বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।’
সারের নতুন ডিলার নিয়োগে রাজনৈতিক প্রভাব থাকবে না জানিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, ‘নীতিমালাটির একটি অনুমোদন হয়েছে কিন্তু সেটি এখনো চূড়ান্ত না। এটিতে সংযোজন-বিয়োজন বা কাটাছেঁড়া হতে পারে। এরপর সেটি অফিশিয়াল ফাইলে অনুমোদন হলে যখন আমরা বলব তখন থেকেই কার্যকর হবে। এটি চূড়ান্ত হয়ে গেছে বলা যাবে না, তবে চূড়ান্ত প্রক্রিয়ার শেষদিকে আছি। ডিলার নিয়োগে যেন স্বচ্ছতা থাকে সেজন্যই আমরা এ চেষ্টা করছি। এখানে রাজনৈতিক প্রভাবের সুযোগ একেবারেই সীমিত। প্রতিটি ইউনিয়নে ডিলার নেয়ার জন্য তাকে সেখানকার বাসিন্দা হতে হবে। নীতিমালার অধীনে যেসব যোগ্যতা রাখা হয়েছে সেসব থাকতে হবে। এরপর স্থানীয় প্রশাসন যাচাই করে যাদের কথা সুপারিশ করবে আমরা তাদের সুযোগ দেব। সেখানে পুরোপুরি স্বচ্ছতা থাকবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘সরকারি চাকরিজীবী, সরাসরি রাজনৈতিকভাবে সংশ্লিষ্ট অথবা নির্বাচনে অযোগ্য (নীতিমালা অনুযায়ী যোগ্য না হলে) তারা এ প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারবেন না। একই পরিবার থেকে একের বেশি ডিলার হতে পারবে না। আগে যদি একাধিক থাকে তাহলে বাদ হবে—এমন অনেক বিষয় আছে। যা কিছু হবে নিয়মের মধ্যেই যেতে হবে। এটি করলে কৃষকেরই সুবিধা হবে।’
নির্বাচনের আগে সব ডিলার নিয়োগ দেয়া সম্ভব হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে কৃষি সচিব বলেন, ‘এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। অর্ধেকের বেশি নিয়োগ তো দেয়াই আছে। যারা আছেন তারা থাকতে চাইলে আমরা বাদ দেব না। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী তাদের রিনিউয়াল করা হবে। যারা অনিয়মে যুক্ত ছিলেন তারা বাদ যাবে।’
সূত্র : বণিক বার্তা