ঢাকা, বাংলাদেশ

‘ফ্রি ভিসা’র ফাঁদ

প্রকাশিত :

ড. জাহাঙ্গীর আলম সরকার : একটি পরিবারের আর্থিক ভবিষ্যৎ, একটি গ্রামের স্বপ্ন, কিংবা একজন মায়ের বুকভরা আশার নাম ‘বিদেশ যাওয়া’। গ্রামীণ জনজীবনে এই শব্দ দুটি যেন এক মায়াময় মোহের প্রতীক হয়ে উঠেছে। পুকুর ঘাটে দাঁড়িয়ে মা ভাবেÑ ছেলেটা বিদেশে যাবে, সংসারের অভাব ঘুচবে; ছোট ভাই ভাবে তখন ঘরে টেলিভিশন আসবে, নতুন জামা কিনবে ঈদে; আর বৃদ্ধ পিতা নিঃশব্দে ভাবেÑ জীবনের শেষ বয়সে অন্তত অভাবমুক্ত নিশ্বাস নেওয়া যাবে। এ এক স্বপ্ন, যা বৃষ্টিভেজা ধানখেতের ওপর দিয়ে, পাড়ার চায়ের দোকানের আড্ডা পেরিয়ে, জড়িয়ে থাকে গ্রামের প্রতিটি শ্বাসে।

প্রতিদিন অগণিত তরুণ পাড়ি জমায় সেই স্বপ্নের পথেÑ কেউ এজেন্সির দালালের হাত ধরে, কেউ আত্মীয়ের আশ্বাসে, কেউ বা নিঃস্বতার তাড়নায়। তারা ভাবে, কয়েক বছরের কষ্টে পরিবারের মুখে হাসি ফোটাবে, সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়বে, পুরানো ঘরটা পাকা করবে, হয়তো একদিন গর্বের সঙ্গে নিজের গ্রামে ফিরবে। কিন্তু এই স্বপ্নের আড়ালেই লুকিয়ে আছে এক ভয়াবহ প্রতারণা, এক নির্মম বাস্তবতা। যে স্বপ্নকে তারা জীবনের আশা ভেবে বুকের ভেতর ধারণ করে, সেই স্বপ্নই অনেক সময় ভেঙে যায় বিদেশের অনিশ্চিত গলিতে, আইনহীন শ্রমবাজারে কিংবা প্রবাসী ক্যাম্পের অন্ধকার কক্ষে। প্রতারণার এই চক্র, শোষণের এই অব্যাহত ধারা এখন কেবল কয়েকজনের ব্যক্তিগত দুর্ভাগ্য নয়, এটি রূপ নিয়েছে এক জাতীয় সংকটে, যার নাম ‘ফ্রি ভিসা’র ফাঁদ’।

এই ফাঁদে পড়ে স্বপ্নের মতো নিঃস্ব হয়ে ফিরে আসে অগণিত তরুণ। কেউ হয়তো ঋণের দায়ে পরিবার হারায়, কেউ হয়ে পড়ে সমাজের অবাঞ্ছিত বোঝা। অথচ তাদের শ্রম, ঘাম, ও পরিশ্রমের অর্থেই সচল থাকে দেশের অর্থনীতির হৃদস্পন্দনÑ রেমিট্যান্স। বিদেশযাত্রার এই স্বপ্ন যখন প্রতারণার জালে বন্দি হয়, তখন প্রশ্ন জাগে আমরা কি সত্যিই শ্রমজীবী তরুণদের রক্ষা করতে পারছি? নাকি আমরা নীরব দর্শক হয়ে দেখছি এক জাতির স্বপ্নকে ধীরে ধীরে নিঃশেষ হতে?
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। এই রেমিট্যান্সের বড় অংশ আসে এমন সব মানুষের কাছ থেকে, যারা ‘ফ্রি ভিসা’র মতো প্রতারণামূলক ব্যবস্থার শিকার হয়ে বিদেশে গিয়েছেন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (ওখঙ) কনভেনশন অনুসারে ‘ফ্রি ভিসা’ বলে কোনো বৈধ ধারণা নেই। এটি মূলত এক ধরনের অবৈধ ও প্রতারণামূলক লেনদেন, যার মাধ্যমে কোনো স্পনসর বা এজেন্ট কেবল দেশে প্রবেশের অনুমতি দেয়, কিন্তু চাকরির নিশ্চয়তা দেয় না। এর ফল বিদেশে পা রাখার পরই শুরু হয় অনিশ্চয়তা, অবৈধ অবস্থান, কাজের খোঁজে হন্যে হয়ে ঘোরা, আর শেষে কারাগার বা দেশে ফেরত পাঠানোর বেদনাদায়ক পরিণতি।

অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাপ) এক সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, সরকার নির্ধারিত খরচের চেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি অর্থ ব্যয় করছেন বিদেশগামী শ্রমিকরা। এই বিপুল অর্থের বড় অংশ চলে যায় দালাল ও অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সির পকেটে। ওই জরিপ অনুযায়ী ৭২ শতাংশ কর্মী বিদেশে যেতে ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছেন, ১১ শতাংশ জমি বন্ধক রেখেছেন, ৬ শতাংশ পারিবারিক সম্পদ বিক্রি করেছেন। কিন্তু এত ত্যাগের পরও ৪৩ শতাংশ কর্মী গন্তব্যে পৌঁছে কোনো কাজ পাননি। কেউ কেউ বাধ্য হয়ে অবৈধভাবে অন্যত্র গিয়ে কাজ করেন। কেউ আবার দেশে ফিরে আসেন ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে। এই ভয়াবহতার মূল শিকড় দেশে থাকা দালাল চক্র। তারা গ্রামীণ সহজ-সরল মানুষদের লোভ দেখায় ‘ফ্রি ভিসা’, ‘সহজ চাকরি’, ‘কম সময়ে যাত্রা’ ইত্যাদি মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে।


বাস্তবে তারা একটি অবৈধ বাজার তৈরি করেছে, যেখানে মানুষের স্বপ্ন বিক্রি হয়, জীবনের নিরাপত্তা নিলামে ওঠে। যদিও আইন অনুযায়ী রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমেই কর্মী পাঠানোর কথা, বাস্তবে মাত্র ৭ শতাংশ কর্মী সরাসরি বৈধ এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশে যান। বাকিরা দালাল ও মধ্যস্বত্বভোগীদের শিকার হন। ফলে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় বিশাল এক অবৈধ অর্থনীতি, যার পরিণাম ভোগ করেন সাধারণ মানুষ।
সরকার একাধিকবার ‘অভিবাসন ব্যয় নির্ধারণ’, ‘রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলককরণ’ ইত্যাদি উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু বাস্তবায়ন কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছায়নি। অনেক সময় প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমও প্রশাসনিক জটিলতা ও প্রভাবশালী মহলের স্বার্থে থেমে যায়। যদি সত্যিই এই প্রতারণা বন্ধ করতে হয়, তাহলেÑ
১. অবৈধ দালাল ও প্রতারণামূলক এজেন্সির বিরুদ্ধে দ্রুত ও কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
২. সরকার নির্ধারিত অভিবাসন ব্যয় বাস্তবায়নে কঠোর নজরদারি রাখতে হবে।
৩. তৃণমূল পর্যায়ে সচেতনতা কার্যক্রম বাড়াতে হবে। যাতে মানুষ বুঝতে পাওে ‘ফ্রি ভিসা’ আসলে কোনো আশীর্বাদ নয়, বরং একটি ভয়াবহ ফাঁদ।
৪. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সরকারকে দক্ষ কর্মী তৈরির প্রশিক্ষণ ও সার্টিফিকেশন কার্যক্রমে জোর দিতে হবে।
দক্ষ কর্মী মানেই বেশি আয়, নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং প্রতারণার সম্ভাবনা কম। আমরা যদি কেবল বিদেশে ‘মানুষ পাঠানো’-র প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত থাকি, তাহলে সেটা রাষ্ট্রের জন্য দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি বয়ে আনবে। বরং প্রয়োজন ‘মানসম্পন্ন শ্রমশক্তি’ তৈরি করা, যারা বিদেশে গিয়ে কাজের মানে প্রমাণ করবে, সম্মান অর্জন করবে এবং দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে। দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোকে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দিতে হবে। বিদেশে কর্মসংস্থানের আগে প্রত্যেক কর্মীকে শ্রম আইন, সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা ও মৌলিক ভাষা জ্ঞান বিষয়ে প্রস্তুত করা জরুরি।

একজন প্রবাসীর প্রতারণায় পড়া মানে কেবল তার নিজের ক্ষতি নয়, তার পরিবারের ভবিষ্যৎ, সমাজের আর্থিক ভারসাম্য, এমনকি দেশের অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই এখন সময় এসেছে ‘ফ্রি ভিসা’র মিথকে ভেঙে দেওয়ার। প্রবাস যাত্রা যেন কেবল একটি ‘টিকিট’ নয়, বরং একটি বৈধ, স্বচ্ছ ও মানবিক প্রক্রিয়া হয়Ñ এটাই রাষ্ট্র, সমাজ ও মানবাধিকারের দাবি।
‘ফ্রি ভিসা’ শব্দটি শুনতে যতটা মুক্তির প্রতীক মনে হয়, বাস্তবে এটি ততটাই এক অদৃশ্য শৃঙ্খল, এক নিঃশব্দ কারাগার। এই ভিসা আমাদের তরুণদের রক্ত, ঘাম আর স্বপ্নকে বেঁধে ফেলে শোষণের জালে; কেড়ে নেয় তাদের আত্মমর্যাদা। কেড়ে নেয় ঘরে ফেরার হাসিটুকুও। যে যুবক একদিন পরিবারের ভবিষ্যৎ গড়ার আশায় বিদেশে গিয়েছিল, সে-ই ফিরছে নিঃস্ব, আহত এবং প্রায়ই সমাজের উপেক্ষিত এক পরিসংখ্যানে পরিণত হয়ে। কিন্তু দোষ কেবল তার নয়।

রাষ্ট্র যদি তার নাগরিককে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, যদি আইনের শাসন দুর্বল হয়, যদি মিডিয়া ও সমাজের চোখ বুজে থাকে, তবে প্রতারণা যে বাড়বেই, তা অবধারিত। তাই এখন সময় এসেছে সত্যিকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা, কঠোর আইনি প্রয়োগ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসনিক তৎপরতা নিশ্চিত করার। পাশাপাশি, মিডিয়ার অনুসন্ধানী ভূমিকা এবং নাগরিক সমাজের সজাগ অংশগ্রহণ এই প্রতারণার অন্ধকারে আলোর দিশা দেখাতে পারে।
আমাদের বুঝতে হবে, বিদেশযাত্রা কোনো লটারির টিকিট নয়; এটি একজন মানুষের জীবন, একটি পরিবারের ভবিষ্যৎ, একটি রাষ্ট্রের মর্যাদার প্রশ্ন। প্রতিটি অভিবাসী শ্রমিক কেবল রেমিট্যান্স পাঠায় না; সে পাঠায় আস্থা, ত্যাগ, আর অদম্য পরিশ্রমের ফসল। তাই তাকে সুরক্ষিত রাখা মানে দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডকে সুরক্ষিত রাখা। যেদিন একজন তরুণ বিদেশে গিয়ে প্রতারণার শিকার না হয়ে, ন্যায্য মজুরি ও মর্যাদাপূর্ণ কর্মপরিবেশে কাজ করতে পারবে সেদিনই বলা যাবে, বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থে শ্রম অভিবাসনের নতুন ইতিহাস লিখছে। সেদিন বিদেশগামী বিমানের প্রতিটি টিকিট হবে আর কোনো ফাঁদের প্রতীক নয়, বরং আত্মমর্যাদার, স্বপ্নপূরণের ও মানবিক মর্যাদার পাসপোর্ট। স্বপ্ন তখন বিক্রি হবে না সত্যি হবে স্বপ্ন।

লেখক : ড. জাহাঙ্গীর আলম সরকার; আইনজীবী ও গবেষক
sarkerjahangiralam78@gmail.com